ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এসএমই খাতে করোনার আঘাত ॥ ঘুড়ে দাঁড়াবার প্রত্যয়

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ৬ ডিসেম্বর ২০২০

এসএমই খাতে করোনার আঘাত ॥ ঘুড়ে দাঁড়াবার প্রত্যয়

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রতিষ্ঠানের অবদান দৃশ্যমান। এ শিল্পের মাধ্যমে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে। এসএমই খাতে প্রবৃদ্ধির হার বৃহৎশিল্পের তুলনায় এবং অর্থনীতির জাতীয় গড় প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের সার্বিক উন্নয়নে এসএমই সহায়তা কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও গতিশীল করে এবং পল্লী অঞ্চলে পর্যায়ক্রমিক বিকাশ সাধন করলে অচিরেই এই খাতের প্রবৃদ্ধির হার অর্থনীতির অন্য সকল খাতকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে আশা করা যায়। সে বিবেচনাকে সামনে রেখেই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য করণীয় ও কর্মকৌশল নির্ধারণের জন্য ২০১৪ সালের ঘোষিত সমীক্ষার সফল বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপের ফলে বাংলাদেশের এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদেরে জন্য এক অশনিসঙ্কেত বিরাজ করে। অনিশ্চয়তার এই অমানিশায় সরকারের প্রণোদনায় উদ্যোক্তারা নতুন করে ঘুড়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখে। উদ্যোক্তাদের চলতি মূলধন সুবিধার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা তহবিল গঠন করা হয়। এ ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ, তবে গ্রাহকদের দিতে হচ্ছে ৪ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তারা যাতে ঋণ পান, সে জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ১০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলও গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও ঋণ পাচ্ছেন না ছোট উদ্যোক্তারা। ফলে ঋণে নিশ্চয়তা দিতে গ্যারান্টি স্কিম প্রণয়ন করছে। তবে এ কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য এসএমই খাতের প্রচার ও প্রসার জোরদারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। করোনা মহামারীর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চিত্র এর ব্যতিক্রম নয়। করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে উৎপাদন ও বিপণন সবেচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এ খাতের হাজার-হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। করোনা সঙ্কটের ফলে সৃষ্ট অর্থনীতি ও শ্রম বাজারের অভিঘাত মোকাবেলায় শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও পরিবারের সুরক্ষা এবং উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এসএমই ফাউন্ডেশন এবং ফ্রাইডরিচ-ইবার্ট-স্টিফটাংয়ের বাংলাদেশ কান্ট্রি অফিস আয়োজিত ‘করোনা মহামারী ও এসএমই : অভিঘাত প্রশমন নীতিমালা এবং ভবিষ্যত বিতর্ক-বাংলাদেশে প্রভাব এবং বিশ্বের প্রতিক্রিয়া থেকে শিক্ষা’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শিল্পমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘এসএমই খাত কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, নারীর আর্থিক ক্ষমতায়ন এবং রফতানি আয় বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। রূপকল্প-২০২১, ২০২৪ সালের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন এবং ২০৪১ সাল নাগাদ শিল্পোন্নত বাংলাদেশ গড়তে সরকার নির্ধারিত উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনে এসএমই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর আতিউর রহমান বলেছেন, ‘করোনার প্রভাব হতে এসএমই খাত যাতে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য অংশীজনদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়িয়ে উদ্ভাবনী উপায়ে প্রণোদনার প্যাকেজের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন।’ উল্লেখ্য, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এসএমই খাত থেকে। শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশই এই খাতে, যা সংখ্যায় প্রায় এক কোটি। এই খাত মাসে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে, মজুরি বাবদ প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬০ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছেন। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মোট ৯০ শতাংশ শিল্প ইউনিট এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত। সেই সঙ্গে শিল্প-কারখানায় নিয়োজিত মোট শ্রমিকের ৮৭ শতাংশ এবং মোট সংযোজিত পণ্যের ৩৩ শতাংশ এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত। এ খাতে তুলনামূলক স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান হচ্ছে ২৫ শতাংশ। আর সামগ্রিকভাবে শিল্প খাতে অবদান ৩২ শতাংশ। কেমন আছেন এসএমই উদ্যোক্তারা? ৮ম জাতীয় এসএমই পন্য মেলায় অংশ নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ও তার স্ত্রী আফরোজা সুলতানা। কুষ্টিয়া তাদের কারখানা। কাজ করছে দেড়শ’ শ্রমিক। তিন বছর যাবত ব্যবসা ভালই হচ্ছিল। হঠাৎ করোনার ধাক্কায় বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। দুই মাস ধরে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়েছে। নানারকম পাটপণ্য ও হস্তশিল্প তৈরি হয় তাদের কারখানায়। তবে সংকটকালীন তাদের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অসহায় বোধ করছে। আশা করা যায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুষ্ঠু ও যথাযথ বণ্টন তাদেরকে নতুনভাবে ঘুড়ে দাঁড়াবার পথ দেখাবে। পাশাপাশি জাতীয় এসএমই মেলা অনুষ্ঠিত হবার সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার মতই একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারণ করার ব্যাপারে উদ্যোক্তারা মত প্রকাশ করেণ। কারণ ক্রেতা দর্শনার্থীর সমাগম বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন। কিছু উদ্যোক্তারা বলেছেন, বাণিজ্য মেলা ও এসএমই মেলার ভেন্যু পাশাপাশি অবস্থান করায় আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলা ও জাতীয় এসএমই মেলা একই সময় নির্ধারণ করলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য লাভজনক। সুইফোঁড় বুটিকসের স্বত্বাধিকারী মহুয়া আক্তারী আট বছর আগে শুরু করেছিল তার পথচলা। করোনার আঘাতে তার বিক্রয় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। মহুয়া বলেন, বাণিজ্য মেলার মতো জাতীয় এসএমই মেলার ফিক্সট ডেট থাকলে মেলা সম্পর্কে সবাই জানত ও বিক্রি ভাল হতো। ইকোফ্রেন্ডলি এবং রিসাইকেল প্রোডাক্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন আরমিন ইসলাম বিপা। ২০১৩ সালে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে তার এ ব্যবসার শুরু। প্রকৃতিপ্রেমী এ উদ্যোক্তা তার প্রোডাক্টের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমাতে চায়। আরমিন বলল শৌখিন ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। তবে পরিস্থিতি আবার ঠিক হবে এবং ভবিষ্যতে তার পণ্য রফতানি করবে এমনটাই প্রত্যাশা। সর্বোপরি এসএমই পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। অর্জিত হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। রূপকল্প-২০২১ ও এসডিজি-২০৩০ এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে এই খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে এটাই প্রত্যাশা।
×