ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বনফুল ঘেঁটু

প্রকৃতিতে পৌরাণিক কিংবদন্তির স্মারক

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২০

প্রকৃতিতে পৌরাণিক কিংবদন্তির স্মারক

সমুদ্র হক ॥ পথের ধারে, ঝাউ বনে অনাদরে কত ফুল ফোটে। কোনটির নাম আছে, কোনটির নেই (!)। নাম হারা ফুলের খবর রাখে না কেউ। যেগুলোর নাম আছে সেগুলোও চাপা পড়ে যায়। প্রকৃতির দেয়া এদের নাম বনফুল। অগোচরে পরিচর্যা ছাড়া অবহেলায় ফোটে। এক সময় ঝরেও যায়। মনেও রাখে না কেউ। গ্রামের পথের ধারে ঘাস ও লতাপাতা গজিয়ে ওঠে। এর মধ্যেই কখন যে বনফুলের ছোট্ট বিছানো গাছ গজিয়ে উঁকি দেয় বুঝতেই দেয় না। প্রকৃতি প্রেমী ও ফুল প্রেমীদের চোখেও সহসা ধরা দেয় না। এই লুকোচুরির মধ্যে গ্রামের কোন শিশু কিশোর অচেনা অজানা বনফুল কুড়িয়ে আনে। কিশোর প্রণয়ে এই অচেনা ফুল দিয়ে প্রণয়ের মানুষকে ভালবাসার অর্ঘে খোঁপায় পরিয়ে দেয়। ভাঁট ফুল বা ঘেঁটু ফুল কী এর মধ্যে পড়ে! যে নামেই ডাকা হোক ভাঁট বা ঘেঁটু বাংলার পৌরাণিক কিংবদন্তি বনফুল হয়ে আছে। স্বীকৃতি দিয়েছেন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ। গাছের চিকন শাখায় হাল্কা সবুজ খসখসে এক পাতার সঙ্গে ডালের আগায় সাদা এক ফুল। পাঁচটি পাপড়ির সঙ্গে আবার চার-পাঁচটি করে লম্বা কেশর। হাল্কা বাতাসে এই কেশর পাপড়ির ওপর আছরে পড়ে। অপার নিসর্গের এই রূপকে কল্পনায় এনে বেহুলার পায়ে ভাঁট ফুলের ঘুঙুর তুলে দিয়েছেন। বেহুলা লখিন্দরের পৌরাণিক প্রেমের কাহিনীতে ঘেঁটু ফুল এসেছে নানাভাবে। প্রণয় পর্বে বেহুলা ভাঁট ফুলেরই মালা গেঁথে পরিয়ে দেয় লখিন্দরের গলায়। নানা ঘটনায় লখিন্দরের চিতার ভেলার চারিধার ভাঁট ফুল দিয়ে সাজানো হয়। দেশের বরেণ্য চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তার বেহুলা ছবিতে ভাঁট ফুল এনেছেন সেলুলয়েডের পর্দায়। এই ফুলকে দিয়েই বসন্তে ফুল ফোটা শুরু। ফুলেদের রাজ্যের অগ্রদূত এই ফুলই নাম লিখিয়েছে বনফুলের তালিকায়। বসন্তের শুরুতে ভাঁট বা ঘেঁটু গাছ ও ফুলের কদর বেড়ে যায়। বট পাকুড় গাছের বিয়েতে ঘেঁটু ফুল দরকার হয়। ভাঁট ফুল নানা কর্মকাণ্ডের নক্সা তবে রিক্ত। কেউ সহসা তাকায় না। পথের ধারে অযতনে অবহেলায় ফোটা ফুল পায়ে দলে যায়। কোন সময় হাতের কাছে মনের রঙে রাঙানো ফুলগুলো না থাকলে ভাঁট ফুলই এগিয়ে আসে। এই ফুলকে নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সে’ নামের গল্পে আজব এক প্রাণীর বর্ণনা দিয়েছেন-যার নাম ঘণ্টাকর্ন। গল্পে বলা হয়- এই প্রাণীর কান দু’টো ঘণ্টা। দুইটি লেজ হাতুড়ি। এই লেজ দিয়েই সে ঘণ্টা বাজায়। একবার এক কানে ঝাপটা দিয়ে ঢং শব্দ করে। আরেকবার শব্দ তরঙ্গ শেষ না হতেই আরেক কানে দেয় ঝাপটা। ফের বিকট শব্দ। এই শব্দেরও আবার কয়েকটি ধরণ আছে। একেক শব্দে একেক ঘণ্টাকর্ন মনে হবে। কোনটি আক্রমণাত্মক, কোনটি খসখসে, কোনটি কাসার বাসনের শব্দের মতো, আবার কোনটি গমগম করে ওঠা শব্দ। কোন পৌরাণিকের মতে এই ভাঁট ফুলই হলো ঘণ্টাকর্ন দেবতা। প্রকৃতিতে এই ফুলের অনেক নাম। বনজুঁই, ভাঁট, ঘণ্টাকর্ন, রাজবেলি। ইংরেজী নাম : হিলি গ্লোরি বোয়ার, ওয়াইল্ড জেসমিন। বিজ্ঞান নাম, ক্লিরোডেনড্রাম ভিসকোসাম। ঘেঁটু নরম শাখা প্রশাখায় গুল্ম জাতীয় গাছ। কাণ্ড শক্ত নমনীয়। বাংলাদেশ, ভারত, আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জ মায়ানমার থাইল্যান্ড মালোয়েশিয়া শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বসন্তের ফুল। ঘেঁটু গাছ ও তার ফুলের ভেষজ গুণাগুণ মানব কল্যাণে বড় অবদান রেখেছে বহুকাল ধরে। একটা সময় উপমহাদেশের বৈদ্যরা (গাছ গাছালি দিয়ে ওষুধ বানানো চিকিৎসক) যে রোগকে ধরতে পারতেন না তখন এই ঘেঁটু গাছের ছাল বাকল হামানদিস্তায় পিষে ও রস করে রোগ নিরাময়ের ওষুধ বানাতেন। দাদি নানিরাও ঘেঁটু গাছের কদর করতেন। অসুখ-বিসুখে আঙিনার ধারে কোন ঝাউবন বা পথের ধারে ফোটা ঘেঁটু ফুল তুলে আনতেন। আজ আর সেইদিন নেই, সেদিনের সেই বৈদ্য নেই। তবে হেকিম কবিরাজ আছে। গাছ গাছালির ভেষজ গুণের কথা উঠলে ঘেঁটু ফুল আপন গতিতেই চলে আসে।
×