ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে বক্তব্য রাখবেন বিজয়ের মাসে অর্থনীতিতে মাইলফলক ঘটনা

ভুটানের সঙ্গে আজ ঐতিহাসিক পিটিএ স্বাক্ষর

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ৬ ডিসেম্বর ২০২০

ভুটানের সঙ্গে আজ ঐতিহাসিক পিটিএ স্বাক্ষর

এম শাহজাহান ॥ দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভুটানের সঙ্গে আজ রবিবার ঐতিহাসিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি ‘পিটিএ’ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই চুক্তির ফলে পণ্য আমদানি-রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত হবে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ স্বাধীনের ১০ দিন আগেই ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ভুটান। দেশটির সেই অবদানকে আরও মর্যাদাপূর্ণ করতে ঐতিহাসিক দিনেই প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করা হচ্ছে। দীর্ঘ ২০ বছর চেষ্টার পর অবশেষে বিজয়ের মাসে চুক্তিটি করা সম্ভব হওয়ায় অর্থনীতির জন্য এটি একটি মাইলফলক ঘটনা বলে মনে করছে সরকার। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখবেন। নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তি সই করবেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও ভুটানের অর্থ-বাণিজ্যমন্ত্রী লোকনাথ শর্মা। জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি থাকলেও মুক্ত বাণিজ্য এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি এখন পর্যন্ত কোন দেশের সঙ্গে করা সম্ভব হয়নি। সর্বপ্রথম ২০০০ সালের শুরুতে এ ধরনের চুক্তি করা যায় কি না তা নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করে বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ এ ধরনের চুক্তি করতে গেলে বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল, বাণিজ্য সংগঠনের এ্যাপেক্স বডি এফবিসিসিআইয়ের মতামত গ্রহণ করতে হয়। এরপর চুক্তিটির খসড়া অনুমোদনের আগে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং (যাচাই-বাছাই) সম্পন্ন হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুমোদন করে। সবকিছু ঠিক থাকলে মহান সংসদে সাংসদরা চুক্তিটি পাস করান। এরপর চুক্তিটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের জন্য স্বাক্ষর করেন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী। দীর্ঘ এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ইতোমধ্যে ১১টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করতে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। ভুটানের পর আগামী বছর থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে পিটিএ এবং এফটিএ করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। জানা গেছে, ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য না হলেও এই চুক্তিটি অন্যান্য দেশের সঙ্গে এফটিএ-পিটির ‘মডেল’ হিসেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দেশগুলো এখন বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি চায়। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়েনের কয়েকটি দেশ মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এসব দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে সেটি দীর্ঘ পর্যালোচনার বিষয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, ভুটানের সঙ্গে পিটিএ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর এ ধরনের একটি চুক্তি করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভুটান বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং প্রথম স্বীকৃতিকারী দেশ। এ কারণে মহান বিজয়ের দিবসের প্রাক্কালে করা হচ্ছে। এরপরই আরও ১১টি দেশের সঙ্গে সঙ্গে করার প্রস্তুতিতে আছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, পিটিএ করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। এর আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নেয়া হয়। বাংলাদেশ এই চুক্তির ফলে লাভবান হবে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন। এছাড়া বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা বেইলি রোডের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা থেকে বেলা ১১টায় ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। করোনার কারণে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি ভার্চুযালি করার সিদ্ধান্ত নেয় দুদেশ। প্রসঙ্গত, আগামী দুই বছরের মধ্যে এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ কারণে ২০২৪ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছ থেকে আমদানি-রফতানিতে যেসব শুল্ক সুবিধা পাওয়া যেত, তা আর বহাল থাকছে না। এ কারণে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যেন মধ্যম আয়ের ফাঁদে না পড়ে, সে জন্য বিশ বছর আগে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ ও পিটিএর মতো চুক্তি করার প্রচেষ্টা। যাতে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী যায়। আর এ কারণে পরীক্ষিত বন্ধু ভুটানের সঙ্গে প্রথম পিটিএ চুক্তি করা হচ্ছে। এর পর পর্যায়ক্রমে ভারত, চীন, ইরান, শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং তুরস্ক। এছাড়া আরও ৪৩টি দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যে সম্পাদিত বাণিজ্য চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে এসব দেশের সঙ্গেও পিটিএর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। দ্বিপক্ষীয় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির (পিটিএ) মাধ্যমে বাংলাদেশ ১০০টি পণ্য এবং ভুটান ৩৪টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় রফতানির সুযোগ পাবে। পর্যায়ক্রমে আলোচনার মাধ্যমে পণ্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে দুই দেশ। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ হলে বাংলাদেশ পাট ও পাটজাতীয় পণ্য, চামড়া পণ্য ও জুতা, ফ্যান, ড্রাই সেল ব্যাটারি, ঘড়ি, আলু, কনডেন্সড মিল্ক, সিমেন্ট, টুথব্রাশসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি বাড়বে। অন্যদিকে ভুটানের কমলা, আপেল, আদা, ফলের জুস, পাথর, কাঠ, চুনাপাথরসহ অন্য পণ্য আমদানি হবে বাংলাদেশে। ভুটানের পাথর বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় অগ্রাধিকারমূলক ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, করোনা সঙ্কট ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ এখন অর্থনীতির সামনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি একটি বড় বিষয়। আর এ কারণে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করা হবে। এ পর্যন্ত ১১ দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। শীঘ্রই এসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হবে। এর বাইরে নেপাল, ইন্দোনেশিয়া ও ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষরের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শীঘ্রই এ ধরনের বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষর করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
×