ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকাসহ ৫৩ জেলায় মানববন্ধন

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী অপশক্তিকে কোন ছাড় নয়

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী অপশক্তিকে কোন ছাড় নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীরা একইসঙ্গে বাংলাদেশবিরোধী। উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছে। আর তাদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংস্কৃতিকর্মীদের মানববন্ধন থেকে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বকারী সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের শত শত নেতাকর্মী এতে অংশ নেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বানে একই সময় কর্মসূচী পালন করা হয় দেশের ৫৩ জেলায়। রাজশাহী পঞ্চগড় নীলফামারী লালমনিরহাট সিলেট সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ মৌলবীবাজার নেত্রকোনা ফরিদপুর রাজবাড়ী শরিয়তপুর মাদারীপুর গোপালগঞ্জ বরগুনা পটুয়াখালী ঝালকাঠী সাতক্ষীরা খুলনা পাবনা সিরাজগঞ্জ চাঁপাইনওয়াবগঞ্জ নওগাসহ বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধনের পাশাপাশি কবিতা গানে প্রতিবাদ জানান সংস্কৃতিকর্মীরা। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিকেল ৩টায় সব ধারার সংস্কৃতিকর্মীরা মানববন্ধনে অংশ নেন। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, পথনাটক পরিষদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থা, চারুশিল্পী সংসদ, যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটসহ অনান্য সংগঠন নিজস্ব ব্যানার প্ল্যাকার্ড হাতে মানববন্ধনে যোগ দেয়। এ সময় আয়োজকদের পক্ষে জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীরা একইসঙ্গে বাংলাদেশবিরোধী। উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছে। আর তাদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তিনি বলেন, ভাস্কর্য একটি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। পৃথিবীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে ভাস্কর্য রয়েছে। ইরানের ধর্মীয় নেতা খুমেনির ভাস্কর্য রয়েছে। পাকিস্তানে জিন্নাহর অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। ওইসব দেশে যদি ইসলামবিরোধী না হয় তাহলে আমাদের এখানে কেন আখ্যায়িত করা হবে? আজকে এমন এক মহামানবের ভাস্কর্যের বিরোধিতা যার জন্ম না হলে জন্ম হতো কিনা সন্দেহ আছে। আমরা মনে করি, সারা পৃথিবীর ইসলামের ব্যাখ্যার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাখ্যা আলাদা হতে পারে না। আসলে এর পেছেনে ধর্ম নয়, রাজনীতি। যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল তাদের ক্ষোভ জিঘাংসা তাদের বেদনা থেকে এই বিরোধিতা। সবার উচিত রুখে দাঁড়ানো। প্রকৃত আলেমদের সাধারণ মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা সবসময় আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বাঙালী সংস্কৃতি ও ক্ষুদ্রজাতিসত্তার সংস্কৃতি লালন ও বিকাশে সচেষ্ট আছি। আমরা শেকড়ের শক্তি নিয়ে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে সারা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। কিন্তু এই অপসংস্কৃতি পিছিয়ে পড়া প্রগতিবিরোধী শক্তি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বারবার আঘাত হেনেছে। সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ থাকতে পারে। সকারের সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ব্যাপারে তো আমাদের মধ্যে ভিন্নমত থাকা উচিত নয়। তাই আমরা মনে করি, আজ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ যখন হুমকির মুখে তখন সপক্ষের সব সংগঠন রাজনৈতিক ছাত্র যুব মুক্তিযোদ্ধা নারী পেশাজীবীসহ সকল দলকে এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী অপশক্তিকে আর কোন ছাড় দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। মানববন্ধনে বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের পক্ষে সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম বলেন, চিহ্নিত অপশক্তিকে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হয়েছে। এ কারণেই এত সাহস দেখাচ্ছে ওরা। স্বাধীনতাবিরোধীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনাদের বাবার দেশ পাকিস্তানেও ভাস্কর্য রয়েছে। এ দেশে কেন থাকবে না? বাংলাদেশের অগ্রগতি থামিয়ে দিতে এবং গোলমাল বাধাতেই ভাস্কর্য বিরোধিতা বলে মন্তব্য করেন তিনি। নৃত্য শিল্পীদের পক্ষে নৃত্যগুরু সাজু বলেন, কিছুকাল আগে ওরা লালানের মতো মহান বাউল সাধকের ভাস্কর্য অপসারণ করেছে। সুপ্রিমকোর্টের ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে ওদের দাবি অনুযায়ী। এভাবেই মূলত আশকারা পেয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। কত বড় সাহস। তিনি বলেন, আজ সারাদেশে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আমরা সমবেত হয়েছি। অথচ এই শহীদ মিনার নিয়েও আপত্তি আছে ওদের। আমরা এভাবে চলতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, ধর্মান্ধরা এখন মদিনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনা করার কথা বলে। তাদের তাহলে সৌদি আরব চলে যাওয়া উচিত। আজই চলে যান। বাংলাদেশ চলবে মুক্তিযুদ্ধের সনদে। মদিনা সনদে নয়। চারুশিল্পীদের পক্ষে চারুশিল্পী সংসদ নেতা সঞ্জীব দাস বলেন, একসময় ওরা মূর্তি ভাঙ্গার কথা বলেছে। ভাস্কর্যবিরোধী কথা বলেছে। আর আজ সাহস এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, জাতির জনকের ভাস্কর্য রুখে দেয়ার কথা বলে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষেরও কিছুটা দায় আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যখন ছোট আকারে তারা এসব শুরু করেছিল আমরা তাদের সেভাবে প্রতিরোধ করতে যাইনি। এ কারণেই আজকের অবস্থা। বাংলাদেশে মূর্তি হবে। ভাস্কর্য হবে। সব সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে সহাবস্থান করবে। সেটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা ১৯৭১ সালেই এ বিষয়টি ফয়সালা করেছি। বাংলাদেশ কাদের হবে? মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর? নাকি উদার অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর? মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার ফয়সালা হয়েছে। তখনই পরাজিত অপশক্তি বাংলাদেশের জন্মকে মেনে নেয়নি। আজও তারা স্বাধীনতার মূল চেতনার পরিপন্থী। ভাস্কর্য ও বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তিকে সমূলে উৎপাটন করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। নাট্যকর্মীদের পক্ষ্যে পথনাটক পরিষদের সহসভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, চিহ্নিত মৌলবাদী গোষ্ঠী নীরবে সংগঠিত হচ্ছে। সামনে হয়ত আরও বড় কোন হুমকি আসবে। আমরা কি সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব? না। অনেক হয়েছে। এখই এই মুহূর্ত থেকে এদের গোটা বাংলাদেশে প্রতিরোধ করতে হবে। সেভাবেই নাট্যকর্মীদের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। আবৃত্তি শিল্পীদের পক্ষে আজহারুল হক আজাদ বলেন, এখনও অনেকে মনে করছেন কিছুদিন পর এই অপশক্তি গর্তে ঢুকে যাবে। আসলে তা নয়। বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধীরা থেমে থাকে না। এদের তাই রুখে দাঁড়াতে হবে। একই দাবিতে আগামী ১১ ডিসেম্বর সারাদেশের সব উপজেলায় মানববন্ধন কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে মৌলবাদী গোষ্ঠী। মামুনুল নামের এক ফতোয়াবাজের ঔদ্ধত্য এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সে জাতির জনকের ভাস্কর্য নির্মাণ করা যাবে না বলে ফতোয়া দেয়। তার গলার সমস্ত রগ বেরকরা চিৎকার শুধু শব্দ দোষণের কারণ হয়নি, ভেতরে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানটুকু সবার সামনে স্পষ্ট করেছে। পশ্চাৎপদরা এ ধরনের আরও অনেক রঙ্গ করে বিভিন্ন সময়ে পার পেয়ে গেছে বটে। এবার হয়েছে উল্টো। ফতোয়াবাজ ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে মাঠে নেমেছে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা এখন ঐক্যবদ্ধ। খিস্তি খেউর শোনার পর থেকেই সোচ্চার সাধারণ মানুষ। যে যার অবস্থান থেকে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন তারা। বর্তমানে অভিযুক্ত মামুনুল ও বাবুনগরী গংকে গ্রেফতারের জোর দাবি উঠেছে। এ দাবিতে গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়। টিএসসি দোয়েল চত্বর শাহবাগ থেকে শুরু করে মৎস্য ভবন পর্যন্ত জায়গাজুড়ে মানববন্ধনে অংশ নেয় কয়েক হাজার মানুষ। ৬০টি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজ নিজ ব্যানারসহ এতে অংশ নেয়। ওই প্রতিবাদ কর্মসূচীর সম্মুখভাগে ছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
×