ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিজিবি’র অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী

সীমান্তে চোরাচালান নারী ও শিশু পাচার বন্ধ করতে হবে

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৬ ডিসেম্বর ২০২০

সীমান্তে চোরাচালান নারী ও শিশু পাচার বন্ধ করতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে ভালবেসে দেশ ও জাতির প্রতি সেবার মনোভাব নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘আমি এইটুকু বলব, দেশ ও জাতির প্রতি একটা সেবার মনোভাব নিয়ে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হবে। দেশকে ভালবাসতে হবে। মানুষকে ভালবাসতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে যত উন্নত হবে, আপনাদের পরিবারগুলোও উন্নত হবে। শনিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে’র (বিজিবি) ৯৫তম ব্যাচ রিক্রুট মৌলিক প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমান সরকার এখন বিজিবিকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছে। তার সরকার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার পাশাপাশি সীমান্তে চোরাচালান এবং নারী-শিশু পাচার বন্ধে বিজিবিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তুলবে। একটা আধুনিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছি। কাজেই আমাদের বর্ডার গার্ড সেভাবে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হবে। তারা আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার পাশাপাশি চোরাচালানি, নারী ও শিশু পাচারসহ সীমান্তে যেসব অপকর্ম হয় সেগুলো বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে আমরা বিশেষভাবে নজর দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এ্যান্ড কলেজ, সাতকানিয়া, চট্টগ্রামের মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিজিবি’র ৯৫তম রিক্রুট ব্যাচের সকল সদস্যকে সফলভাবে তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করায় অভিনন্দন জানিয়ে শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সবসময় মনে রাখতে হবে যে কোন সুশৃঙ্খল বাহিনীর জন্য সব থেকে বেশি শৃঙ্খলার প্রয়োজন। কাজেই সেদিকে লক্ষ্য রেখে সবাইকে চলতে হবে। বাংলাদেশ যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন হয়েছে, সে আদর্শ নিয়েই চলতে হবে। উর্ধতন কতৃর্পক্ষের আদেশ মেনে কর্তব্য পালনে নির্ভীক থাকতে হবে। আর অধঃস্তনদের প্রতিও সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশটাকে ভবিষ্যতে যেন আমরা আর উন্নত করতে পারি সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সকলে কাজ করবেন, সেটাই আমি চাই। তিনি বিজিবি’র চার মূলনীতি-‘মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে সকলকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এই দেশটা আমাদের, আপনাদের, আমাদের সকলের। এই দেশ উন্নত হলে আপনার বাবা-মা-ভাই-বোন এবং ভবিষ্যত বংশধররা সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে। সেই কথাটা সবসময় আপনাদের মনে রাখতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তৃতা করেন। বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম বিজিবি ট্রেনিং সেন্টার থেকে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীকে অনুষ্ঠান থেকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। তিনি নবীন সদস্যদের মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজও উপভোগ করেন। সববিষয়ে সেরা নবীন সৈনিক হিসেবে বক্ষ নম্বর-৪৩১ রিক্রুট মোঃ খোকন মোল্লাকে প্রথম স্থান অর্জন করায় এবং বক্ষ নং-৬৮৭ রিক্রুট হাসিনা আক্তার বিথি শ্রেষ্ঠ ফায়ারার হওয়ায় উভয়কে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর এই বাহিনীর তৃতীয় রিক্রুট ব্যাচ সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা স্মরণে আনেন প্রধানমন্ত্রী। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আজ আপনাদের কাছে আমি অনেক বড় কর্তব্য দিয়েছি। অনেক বড় কাজ দিয়েছি। এ কাজ হলো চোরাচালানি বন্ধ করা। তোমাদের কাছে আমার হুকুম স্মাগলিং বন্ধ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি তোমরা পারবা। এ বিশ্বাস তোমাদের ওপর আমার আছে। মনে রাখতে হবে স্মাগলারের কোন জাত নাই, ধর্ম নাই। তারা মানুষ নামের নরপশু। তারা এদেশের সম্পদকে বিদেশে চালান দেয় সামান্য অর্থের লোভে।’ জাতির পিতার দেয়া নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আশাকরি, এই নির্দেশনাটাও আপনারা মেনে চলবেন। আমাদের যেমন সার্বভৌমত্ব রক্ষা, স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, পাশাপাশি এই ধরনের অপকর্মগুলো রোধ করে আপনারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবেন। কারণ এই কথাগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনার সেকেন্ড ওয়েভ সম্পর্কে দেশবাসীকে পুনরায় সতর্ক করে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দারিদ্র্যের হার আমরা ৪০ ভাগ থেকে ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে এনেছিলাম এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম আরও ২/৩ ভাগ কমিয়ে আনার। কিন্তু করোনার কারণে সেটা কিছুটা হয়তো থেমে গেছে। যদিও আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যে যেখানে আছেন (সরকারী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং চিকিৎসা কার্যে নিয়োজিত) তারা হয়তো অসুস্থ হচ্ছেন তারপরও দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি এ জন্য সকলকে ধন্যবাদ জানান এবং করোনাকালীন জনগণের কষ্ট লাঘবে বিভিন্ন শ্রেণী পেশা এবং আমজনতার জন্য তার সরকারের প্রদত্ত প্রণোদনার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমরা সকলকেই এভাবে সহযোগিতা করছি যাতে সকলে নিজ নিজ অবস্থানে সুরক্ষিত থাকতে পারেন এবং দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে পারেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই মুজিবর্ষে একটি মানুষও আর গৃহহারা থাকবে না। আর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে দেশের প্রত্যেকটি ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলবে। শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে আবারও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বিজিবি সদস্যদের করোনাভাইরাস যেন ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য সচেতন থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নিজে সুরক্ষিত থাকার পাশাপাশি পরিবারের সদস্য এবং বন্ধু-বান্ধবদের সুরক্ষিত রাখার উদ্যোগ নেবেন। করোনার সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবেলায় যা যা করণীয় তার সবই সরকার করছে। করোনার ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য আমরা টাকার বরাদ্দ দিয়ে ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তার সরকারের সময় বিজিবির উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। আমাদের আশু, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে আমরা বাংলাদেশকে যেমন গড়ে তুলছি, তেমনি বিজিবিকেও ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। জাতির পিতা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি করে গেলেও ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো-জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার কেউই ভারতের সঙ্গে এই চুক্তির বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বর্ডার গার্ডের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই কেবল দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা হয় বলেও উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমান্তের উন্মুক্ত এলাকাগুলোতে নতুন নতুন বর্ডার পোস্ট তার সরকার নির্মাণ করছে। শেখ হাসিনা বলেন, বিজিবিকে আরও শক্তিশালী করা এবং সীমান্তের প্রতিটি জায়গায় যেন তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয় সে ব্যবস্থা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘বর্ডার গার্ড ভিশন-২০৪১’ প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ তার সরকার এখন বিজিবিকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছে। বাহিনীতে হেলিকপ্টারের সঙ্গে নদীমাতৃক এই দেশের সীমান্ত প্রহরায় নৌযান সংযুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে জলে, স্থলে এবং আকাশ পথে- সর্বত্রই বিজিবি’র এখন বিচরণ রয়েছে। ১৫ হাজার জনবলের ধাপে ধাপে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তার সরকারই বিজিবিতে প্রথম নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী সদস্য আমরা নিতে শুরু করেছি। পাশাপাশি আধুনিক সরঞ্জামাদি যা যা প্রয়োজন তারজন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। স্মার্ট বর্ডার ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে সীমান্তে নতুন বিওপি, বিএসপি নির্মাণসহ অত্যাধুনিক সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট স্থাপন, এটিভি ও অত্যাধুনিক এপিসি, ভেহিক্যাল স্ক্যানার ও দ্রুতগামী জলযান সংযোজন করার মাধ্যমে বিজিবি’র উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পাশাপাশি বিজিবি সদস্য ও পরিবারবর্গের চিকিৎসা সেবায় বিজিবি’র ৫টি হাসপাতালকে আরও উন্নত করা হয়েছে। বিজিবি হাসপাতাল, ঢাকায় একটি অত্যাধুনিক ক্যাথ ল্যাব ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণা দেশব্যাপী প্রচারে অংশ নেয়ার কারণে চরম নির্যাতনে শহীদ তৎকালীন ইপিআর সদস্যসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিজিবি সদস্যদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এ বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৮১৭ জন সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাদের আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও বিজিবি’র নবীন সদস্যরা তাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে পারায় প্রধানমন্ত্রী এ জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এটা একটা কঠিন কাজ ছিল। কারণ করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বটাকে স্থবির করে রেখেছে। যে কারণে আজকের অনুষ্ঠানটিও তাকে ভার্চুয়াল করতে হয়েছে। কেউ যাতে সংক্রমিত না হয় সে কথা চিন্তা করেই তার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে করোনাকালীন বিভিন্ন কর্মসূচী ভার্চুয়ালি আয়োজন করে যাচ্ছে।
×