ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দাম কমে নাগালের মধ্যে

দশ বছরে ইলিশ উৎপাদন দ্বিগুণ, গড় ওজন বেড়েছে ৩৫০ গ্রাম

প্রকাশিত: ২২:২৯, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

দশ বছরে ইলিশ উৎপাদন দ্বিগুণ, গড় ওজন বেড়েছে ৩৫০ গ্রাম

কাওসার রহমান ॥ গত ১০ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিগত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। চলতি বছর ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ টনে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ইলিশ-ই হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে শুধু যে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে তাই নয়, প্রচুর বড় বড় ইলিশও ধরা পড়ছে। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা ধরা বন্ধ এবং ২২ দিনের নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা বন্ধের কারণে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে চলেছে। দামও কমে এসেছে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। সেইসঙ্গে বেশি ওজনের ইলিশও এখন পাওয়া যাচ্ছে। সাগর ও নদ-নদীতে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন গত তিন বছরে ৩৫০ গ্রাম বেড়েছে। আবার ১৫ বছর আগে দেশের ২৪টি উপজেলার নদীতে যেখানে ইলিশের বিচরণ ছিল, এখন দেশের অন্তত ১২৫টি উপজেলার নদীতে ইলিশ বিচরণের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এর সবই সম্ভব হচ্ছে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে। অবশ্য ইলিশ ধরার ওপর এই নিষেধাজ্ঞার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে অন্যান্য মাছেও। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইলিশের পাশাপাশি নদীতে পাঙ্গাস মাছের উৎপাদনও বেড়ে গেছে। গত কয়েকসপ্তাহ ধরে দেশের কয়েকটি এলাকার নদীতে বিপুল পরিমাণ পাঙ্গাস মাছ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। মৎস্য কর্মকর্তা ও মৎস্য গবেষকরা বলছেন ইলিশ মাছ সংরক্ষণের উদ্দেশে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুফল হিসেবে অন্যান্য বছরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি ও বড় আকারের পাঙ্গাশ মাছ এ বছরে ধরা পড়ছে। মূলত মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা সংলগ্ন পদ্মা নদীতে বিপুল পরিমাণ পাঙ্গাশ মাছ ধরা পড়ার ঘটনা ঘটছে গত কয়েক সপ্তাহে। এ বছরে বিপুল পরিমাণ পাঙ্গাশ মাছ পাওয়ার কারণ হিসেবে মৎস্য কর্মকর্তারা কয়েক বছরের মৎস্য সংরক্ষণ কার্যক্রমের সুফল হিসেবে মনে করছেন। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা জাকির হোসেন মৃধা বলছেন, ওই এলাকা সংলগ্ন অঞ্চলে অন্যান্য বছরের তুলনায় অন্তত ২৫ ভাগ বেশি পাঙ্গাশ মাছ ধরা পড়েছে এ বছর। ইলিশ মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে গত বেশ কয়েকবছর ধরে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। এই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা হচ্ছে ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নবেম্বর ২২ দিন। এই ২২ দিন বাংলাদেশে ইলিশ মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুদ ও পরিবহন নিষিদ্ধ। এর লঙ্ঘন করা হলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ইলিশ গবেষকরা বলছেন, এই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলছেন, ঠিক এই সময়টাতে মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে শুরু করে। একটা মা ইলিশ চার থেকে পাঁচ লাখ ডিম ছাড়ে। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলছে, শুধুমাত্র গতবছরে অন্তত ৭ লাখ ৪০ হাজার কেজি ডিম ছাড়া হয়েছে। সেগুলো বড় হওয়ার সুফল এই বছর আপনারা দেখতে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, এর অর্ধেক যদি নিষিক্ত হয়, তার মধ্যেও ১০ শতাংশও যদি বাঁচে, তাহলে ৩৭ হাজার কোটি ইলিশ পোনা বা জাটকা পাওয়া যায়। সেটা যে হয়েছে, তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। সেটা না হলে দিনের পরদিন এ রকম বড় বড় ইলিশ, এত ইলিশ ধরা পড়ত না। এই বছর বাংলাদেশের বাজারে অনেক কম দামে বড় আকারের ইলিশ মাছ বিক্রি হয়েছে। নদী ও সাগরে তুলনামূলকভাবে বেশি বড় ইলিশও ধরা পড়েছে। আগে যেখানে এক কেজির ওপরের ইলিশের কেজি কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এই বছর বাংলাদেশে সেটা হাজার টাকার নিচে নেমে এসেছে। ইলিশ এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। ইলিশ মাছ আকারে যত বড় হবে, তত তার স্বাদ বেশি হবে। আকারে বড় ইলিশকে অনেকে পাকা ইলিশ বলে অভিহিত করে থাকেন। ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ইলিশের উৎপাদন যে বেড়েছে, সেটা তো এখন সবাই বুঝতে পারছে। সেই উৎপাদন বাড়ার পেছনে যেসব কারণ আমরা দেখতে পেরেছি, তার মধ্যে এই ২২ দিনের ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞাটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। বাংলাদেশে ২০০৩-২০০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচী শুরু করা হয়। তখন থেকেই আস্তে আস্তে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল। ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে পরে মিলিয়ে ১১ দিনের ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তখন থেকেই এর সুফল দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তখন তারা গবেষণায় দেখতে পান যে, শুধু পূর্ণিমায় নয়, এই সময়ের অমাবস্যাতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। পরবর্তীতে পূর্ণিমার সঙ্গে অমাবস্যা মিলিয়ে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া শুরু হয়। এ সময় ইলিশ শিকার, আহরণ, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এছাড়া আট মাস জাটকা নিধন এবং ৬৫ দিন সাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকছে। সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উদ্দীপনামূলক প্রচারাভিযান চালানো হয়। নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা ঠেকাতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি জেলেদেরও মানসিকভাবে এই কার্যক্রমে যুক্ত করে উপকূলীয় এলাকায় প্রচার কাজ চালানো হয়, যাতে জেলেরা নিজেরাই নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিরত থাকেন। এই ২২ দিন ইলিশ ধরতে না পারায় জেলেদের কষ্ট সহ্য করতে হয়। তাই এজন্য ৩৬টি জেলার ১৫২টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি জেলে পরিবারের জন্য ২০ কেজি হারে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম শুরুর পূর্বেই চাল বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এ মৌসুমে গত মৌসুমের তুলনায় অতিরিক্ত ১ লক্ষ ২০ হাজার ২৬৩টি জেলে পরিবারকে এ খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, এক সময় ১১ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল, পরে ১৫ দিন বন্ধ ছিল, এখন ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ। আসলে ইলিশ সারাবছরই ডিম দেয়। তবে এই ২২ দিন ৬০-৭০ ভাগ ইলিশ ডিম দেয়। যার কারণে উপযুক্ত সময় হিসেবে এই ২২ দিনকে ধরা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ২২ দিন ঠিক আছে। মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের ৫ বছর পর থেকে দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। মূলত ২০১৪-২০১৫ সালের পর থেকে দেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বেড়ে আসছে। রাতারাতি উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ আইনটা আগে থাকলেও ওই সময় থেকে কড়াকড়িভাবে তা পালন করা শুরু হয়। ফলে ২০১৮-১৯ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ইলিশ ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন। আর দশ বছর আগে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। শুধু তাই নয়, এখন উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রচুর বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। সম্প্রতি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ড ফিসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশে ইলিশের গড় ওজন বেড়েছে প্রায় ৩৫০ গ্রাম। পাঁচ বছর আগে ধরা পড়া ইলিশের অর্ধেকই ছিল ছোট ও মাঝারি আকৃতির। বড় ইলিশ পাওয়া যেত ২০-৩০ শতাংশ। চলতি বছর এ পর্যন্ত ধরা পড়া ইলিশের ৭০ শতাংশের ওজন ৫৫০ থেকে ১ হাজার ২৫০ গ্রাম, এর মধ্যে ৫৫০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ হচ্ছে ৫৫ শতাংশ। এক কেজি থেকে ১ হাজার ২৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে ১৫ শতাংশ। গতবছর ৮৭০ গ্রাম গড় ওজন এর বিপরীতে এবার ইলিশের গড় ওজন ৯১৫ গ্রামে দাঁড়িয়েছে। ওজন ও আকৃতি বাড়ায় বেড়েছে ইলিশের মোট উৎপাদন। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আর প্রতিবছরই ২০-৪০ টন করে উৎপাদন বাড়ছে। গতবছরের পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার টন উৎপাদনের বিপরীতে এবার প্রায় ৬ লাখ টন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ২২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও কিছুদিন বাড়ানো গেলে হয়ত উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। এসব সম্ভব হয়েছে ইলিশের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিতকরা ও ইলিশের জীবন চক্র সম্পন্ন করতে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কারণে। ইলিশ রক্ষায় সরকার এ পর্যন্ত যে ক’টি পদক্ষেপ নিয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিয়েছে এবং বাস্তবায়নও করেছে কঠোরভাবে। আবার বহির্বিশ্বে রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে ইলিশের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে। ইলিশ মাছ বর্তমানে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। উল্লেখ্য, দেশে ইলিশের চাহিদা মেটানোর জন্য ২০১২ সালের ২ জুলাই সরকার ইলিশ রফতানি বন্ধ করে দেয়। তবে দীর্ঘদিন পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারণে ভারতে কিছু ইলিশ দেয়া হয়, সেটাও একেবারেই নগণ্য। গতবছর ভারতে ৫০০ মেট্রিক টন এবং এ বছর ১৪শ’ মেট্রিক ইলিশ রফতানি করা হয়েছে ভারতে। এর বাইরে আর কোথাও রফতানি হয় না। বাংলাদেশে চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর-এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরে উপকূলের অন্যান্য নদীতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার পর জাটকা বড় হয়ে আবার সাগরে ফিরে যায়। পরে সেগুলো বড় হলে ডিম ছাড়ার জন্য আবার নদীতে ফিরে আসে। মৎস্য অধিদফতরের ইলিশ পর্যবেক্ষণ সেলের হিসেবে ১৫ বছর আগে দেশের ২৪টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। এখন দেশের অন্তত ১২৫টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চারজন শিক্ষকের গবেষণার পূর্ণ প্রতিবেদন ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘প্রাইমারি প্রোডাক্টিভিটি কানেক্টস হিলশা ফিশারিজ ইন বে অব বেঙ্গল’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে গবেষকবৃন্দ বঙ্গোপসাগরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতার সঙ্গে ইলিশের প্রাচুর্যের সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন। তাদের পাওয়া তথ্য মতে, ইলিশের খাদ্য তালিকার ৯৭ থেকে ৯৮ ভাগ হচ্ছে ফাইটোপ্লাংটন বা উদ্ভিদকণা। এর উপস্থিতি বেশি রয়েছে বঙ্গোপসাগরের মেঘনা নদীর অববাহিকায়। ফলে খাবারের টানে মেঘনায় ইলিশের আনাগোনা হয় বেশি। আবার ইলিশের পোনা বা জাটকা খাদ্য হিসেবে পছন্দ করে জুপ্লাংটন বা প্রাণিকণা। এটাও সর্বোচ্চ পাওয়া যায় মেঘনা অববাহিকায়। ফলে মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী ও উপকূলবর্তী অগভীর অঞ্চলে জাটকা বিচরণ করে এবং বেড়ে ওঠে। ফলে মেঘনাতেই ইলিশের উৎপাদন বেশি হয়। পানিভেদে ইলিশ মাছের স্বাদে তারতম্য হয়। ইলিশের স্বাদ মূলত নির্ভর করে মাছটা পরিপক্ক হয়েছে কি না। পরিপক্ক ইলিশ যেখানেই থাকুক স্বাদ বেশি হবেই। বর্তমানে দেশে পরিপক্ক ইলিশ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে স্বাদেও ভাল হচ্ছে। তবে পানিভেদে স্বাদ কিছুটা বেশি হয়, কারণ লবণাক্ত পানি থেকে মিঠা পানিতে যখন ইলিশ আসে, তখন তার খাদ্যাভাস পরিবর্তন হয়। মিঠাপানির খাবারে কিছুটা ফ্যাট থাকে, চর্বি থাকে যার কারণে স্বাদ বাড়ে। জুলাই থেকে অক্টোবরে ইলিশ মিঠা পানিতে আসে, সে সময় স্বাদ বেশি হয়। অধ্যাপক মনিরুল বলেন, স্বাদের তারতম্য নির্ভর করে পানির বৈশিষ্ট্যের ওপর। মিঠা পানি বা স্বাদু পানিতে উদ্ভিদ কণা বেশি থাকে, যার কারণে স্বাদের তারতম্য হয়। যে এলাকার পানি নোনা সেখানে উদ্ভিদ কণার উপস্থিতি একেবারেই কম, যার কারণে স্বাদের তারতম্য হয়। স্বাদের তারতম্যের কারণ হলো, পানিতে প্রোটিনের পরিমাণের কম বেশির কারণে। এছাড়া একেক জায়গার পনির মাছ একেক রকম তৈলাক্ত হয়। স্বাদের তারতম্য থাকলেও মাছের পুষ্টিগুণের কোন তারতম্য হয় না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। আশির দশকের আগে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ২০ শতাংশ ছিল ইলিশের অবদান। কালের পরিক্রমায় কারেন্ট জাল, ছোট ফাঁসওয়ালা জাল ও সরঞ্জাম দিয়ে নির্বিচারে জাটকা এবং মা ইলিশ নিধনের কারণে ২০০২ থেকে ২০০৩ সালে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান ৮ শতাংশে নামে এবং ২০০০-০১ সালে উৎপাদন ২.২৯ মেট্রিক টন থাকলেও ২০০১-০২ ও ২০০২-০৩ সালে কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২.২০ ও ১.৯৯ মেট্রিক টন। দেশের হাট-বাজারগুলো হয়ে পড়ে ইলিশ শূন্য, ইলিশ হয়ে ওঠে সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের খাদ্য। আশার কথা হলো বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান এখন সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ এবং জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ। বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭৬ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। ওয়ার্ল্ড ফিসের তথ্যমতে, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের পরই দ্বিতীয় স্থানে ভারত। চলতি বছরে তাদের উৎপাদন সাড়ে ১০ শতাংশে নেমেছে। তিন শতাংশ উৎপাদন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে মিয়ানমার। বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ইলিশ হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এরজন্য ইলিশ নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। ইলিশের খাদ্যের জোগান ঠিক রাখার পাশাপাশি নদীর পানিদূষণ কমাতে হবে। কারণ পানি দূষিত হলে উৎপাদনশীলতা কমবে। সেইসঙ্গে জাটকা নিধন ও মা ইলিশ ধরা বন্ধের বিকল্প নেই। ইলিশের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে প্রায় আড়াই শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের দেয়া সহায়তার পরিমাণ বাড়ে এবং তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশের ইলিশ এখন ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য। ২০১৭ সালে দেশ এই স্বীকৃতি লাভ করে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের জন্য একটা বড় অর্জন। ইলিশ সংরক্ষণের সুফল পাঙ্গাশে ॥ মৎস্য কর্মকর্তা ও মৎস্য গবেষকরা বলছেন ইলিশ মাছ সংরক্ষণের উদ্দেশে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুফল হিসেবে অন্যান্য বছরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি ও বড় আকারের পাঙ্গাশ মাছ এ বছরে ধরা পড়ছে। মূলত মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলা সংলগ্ন পদ্মা নদীতে বিপুল পরিমাণ পাঙ্গাশ মাছ ধরা পড়ার ঘটনা ঘটছে গত কয়েক সপ্তাহে। মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য গত কয়েকবছর থেকে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশ মাছ ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ওই নিষেধাজ্ঞা ইলিশের পাশাপাশি পাঙ্গাশ মাছের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব্য করেন মুন্সীগঞ্জের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল আলীম। তিনি বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় গত কয়েকবছর ধরে যে ২২ দিন মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তার পাশাপাশি সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা বা জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপগুলোও পাঙ্গাশ মাছের সংখ্যা বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, পাঙ্গাশ মাছের বংশবিস্তার পদ্ধতি এবং ডিম পাড়ার সময় অনেকটা ইলিশ মাছের সঙ্গে মিলে যায়, যে কারণে ইলিশ সংরক্ষণের উদ্দেশে নেয়া পদক্ষেপ পাঙ্গাশ সংরক্ষণেও ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট বিরতিতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার কার্যক্রম টানা কয়েক বছর ধরে বাস্তবায়িত হতে থাকায় ইলিশ মাছের পাশাপাশি পাঙ্গাশ মাছের বসবাসের জন্য অনুকূল পরিবেশ নদীতে তৈরি হয়েছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আখেরী নাইমা বলছেন, ইলিশ মাছের মতো গভীর সমুদ্রে না গেলেও পাঙ্গাশ নদীর মোহনা অঞ্চলে থাকে। বছরের এই সময়টায়, যখন ইলিশ মাছ ডিম পাড়ার জন্য নদীতে আসে, তখন পাঙ্গাশও নদীতে আসে। আর প্রায় দুই-তিন সপ্তাহ মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর এই সময়টায় বেশি পরিমাণ বড় আকৃতির পাঙ্গাশ জেলেদের জালে ধরা পড়ে। মুন্সীগঞ্জ জেলার মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল আলীম মনে করেন জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে এবং মৎস্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নেয়া সরকারের পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে পাঙ্গাশের উৎপাদন আরও কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পাঙ্গাশের পোনা ধরা আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও অনেক জেলেই লুকিয়ে এসব পোনা ধরে। চাঁদপুরে একসময় বড় আকৃতির চাঁই ব্যবহার করে পোনা ধরা হতো। গত কয়েকবছরে কর্তৃপক্ষের ব্যাপক প্রচারণা ও অভিযানের পর ওই ধরনের কার্যক্রম অনেক কমেছে। মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েকবছরে নদীর মাছ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নেয়া এই ধরনের উদ্যোগগুলোই নদীতে পাঙ্গাশের উপস্থিতি বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া গত মাসে দুই দফা নিম্নচাপ হওয়ার কারণেও নদীতে মাছের সংখ্যা বেড়েছে। নবেম্বরের এক তারিখ থেকে আগামী জুন পর্যন্ত জাটকা মাছ ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা থাকবে, তবে অনেক জেলেই এ সময় লুকিয়ে মাছ ধরে। জেলেদের সচেতন করা গেলে এবং এই নিষেধাজ্ঞাগুলো এক-দুই বছর সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে তারপর থেকে বাজার মাছে সয়লাব হয়ে যাবে।
×