দুপুরের কড়া রোদ ক্রমশ পড়ে আসছে। সময় গড়াচ্ছে বিকেলের দিকে। নরম এবং স্নিগ্ধ হয়ে আসছে আলো। গ্রীষ্মকালের বাতাসেও মধুর একটা আমেজ। এ মৃদুমন্দ বাতাসে মন-প্রাণ-শরীর জুড়িয়ে যায়। সব ইন্দ্রিয় ছুঁয়ে এ বাতাস দোলা দেয় গহিন অনুভবে।
তৃণা এখানে এসেছে সকালে। তার এক ঘণ্টা পর এসেছে মারুফ। মারুফ বরাবরই দেরি করে। তৃণাকে অপেক্ষার যাতনা দিতে ভালবাসে। কেউ একজন ওর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এটা নাকি ভীষণ ভাললাগার অনুভূতি দেয়!
তৃণা রাগ করে। কিন্তু মারুফ সে রাগের পরোয়া করে না। রাগাতেই যেন তার আনন্দ।
স্বভাব জানে বলেই তৃণা তাকে বারবার প্রতিজ্ঞা করিয়েছে, অন্তত আজকের দিনটায় কোন দেরি নয়। কোন অপেক্ষাও নয়; দুজনই সমান সময়ে আসবে। একদিন সারাদিন নিজেদের মতো করে, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকবে। মারুফ কথা দিলেও যথারীতি বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখেছে।
স্বভাবতই তৃণার রাগ করা উচিত ছিল। রাগেনিÑজানে, অর্থহীন।
ওরা এসেছে পতেঙ্গায়, সমুদ্র এলাকায়। সকালবেলায় নাস্তা সেরেই কেউ বেড়াতে বের হয় না। কিন্তু ওরা বের হয়েছে। প্রকৃতির রঙ-রূপ নাকি সময় বিশেষে পাল্টায়। কীভাবে পাল্টায় তা বোঝার জন্য দুজনে ঠিক করেছে পুরো একটা দিন এক জায়গায় থাকবে। অনুভব করার চেষ্টা করবেÑকীভাবে ক্ষণ পাল্টায়; আসলেই কি কিছু পাল্টায় নাকি মানুষের দেখার দৃষ্টিটাই বদলে যায়? কিছু আবিষ্কার করা যাক বা না যাক, মধুময় একটা দিন তো কাটবে। মারুফই প্রস্তাবটা দিয়েছিল। কী আশ্চর্য, তৃণাও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেছে, এতটুকু অজুহাত তোলার চেষ্টা করেনি।
ওরা বসেছে সৈকত সংযোগ সড়কের পাশে। ঝাউগাছের নিচে। রাস্তার দুই পাশে সুবিন্যস্ত ঝাউগাছের সারি। ঝাউগাছের ছায়া পড়েছে পুরো রাস্তায়। দুই পাশ থেকেই ছায়া পড়ে বলে রাস্তাটা সবসময় ছায়াময়। থেকে থেকে চলে আলোছায়ার লুকোচুরি। শীতল স্নিগ্ধ মায়াময় পরিবেশ। গ্রীষ্মকালের কাঠফাটা গরমে ওরা বসেছে সেই সকাল থেকে। এখনও কোন গরম বা অস্বস্তি অনুভব করেনি। মাঝে কয়েকবার এদিক-সেদিক হেঁটে স্থান পরিবর্তন করেছে কেবল। শহরের কাছ ঘেঁষে হলেও জায়গাটা গ্রামই। যদিও বাড়িঘর তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। বিচ্ছিন্ন দুই একটা বাড়ি নজরে আসে। তাও বেশ দূরে দূরে। পাশেই কর্ণফুলী। নদীর রূপ-মাধুরী উপভোগ করতে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর আনাগোনা।
ছায়াময় মায়াময় শান্ত সুশীতল মনোরম রাস্তাটির প্রেমে পড়েনি প্রকৃতিপ্রেমী এমন মানুষ কমই আছে। প্রেমিক জুটির সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। থেকে থেকে নদী থেকে উঠে আসে হিমেল হাওয়া। সে হাওয়া শান্তি হয়ে পরশ বোলায় দেহে, মনে।
তৃণা মারুফের সঙ্গে প্রথম যেদিন এখানে বেড়াতে এসেছেÑমুগ্ধ হয়েছে খুব। মারুফের কাছে আব্দার জানিয়েছে, ‘এ্যাই শোনো, বিয়ের পর প্রতি সপ্তাহ আমরা এখানে বেড়াতে আসব।’
মারুফ হেসেছে, ‘তারপর’?
‘পরস্পর হাত ধরাধরি করে হাঁটব।’
‘হেঁটে কতদূর যাবে?’
‘যতদূর ঝাউগাছগুলো সঙ্গ দেবে।’
‘ঝাউগাছ পুরো পথে নেই।’
শুনে হতাশ হয়েছে তৃণা, ‘তাই? আমি তো ভেবেছিলাম...।’
‘শাহ আমানত বিমানবন্দর কাছেই। তোমাকে কোন একদিন নিয়ে যাব।’
‘আর কী আছে?’
‘রাস্তাটা চলে গেছে কর্ণফুলীর তীর ধরে। এখান থেকেই বন্দর এলাকার শুরু বা শেষ। দেশ-বিদেশ থেকে জাহাজে আসা মালামাল এখানেই খালাস হয়। কিছুদূর গেলে চোখে পড়বে নোঙর করা জাহাজের সারি।’
‘সেখানে কোন দিন নিয়ে যাবে?’
‘এখনই চলো।’
‘না। আজ না; আজ শুধু তোমাকে দেখব।’
‘হা হা হা। মজার কথা শোনালে!’
এরপর অনেকদিন তারা এ পথে হেঁটেছে। এখন এ জায়গার খুঁটিনাটি অনেক কিছুই নখদর্পণে। সেই ভ্রমণ-ধারাবাহিকতায় আজও এসেছে। রাস্তার অনতিদূরে তরমুজ ও বাঙ্গির খেত। খেতগুলো খুব সহজেই নজর কাড়ে। তরমুজ-বাঙ্গিগুলোর দশাসই সাইজ। সম্ভবত সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাজারে উঠবে। ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে মারুফ বলে, ‘আমার মাঝে-মধ্যে কী মনে হয় জানো?’
‘কী সোনা?’
‘এখানেই ঘর বাঁধি। আমাদের ছোট্ট সুখের ঘর।’
‘তাই নাকি!’
‘আমি কৃষক হব। তুমি কৃষাণী। বছরজুড়ে আমরা মৌসুমি ফসল ফলাব।’
পরিকল্পনা শুনে তৃণা হাসে।
মারুফ রেগে যায়Ñ‘হাসছ কেন, হাসির কথা বলেছি?’
‘আমার এক খালু কৃষক। খালা কৃষাণী। তাদের প্রেমের বিয়ে। তোমাকে একদিন নিয়ে যাব তাদের সংসার দেখাতে। বাংলাদেশের কৃষকরা খুব একটা সুখে নেই। দেখলে বুঝবে, এটা তোমার ভাবালুতা ছাড়া আর কিছু নয়।’
‘বলেছে তোমাকে! তুমি জান, আমার দাদাও একসময় কৃষক ছিলেন?’
‘খুব জানি!’
‘এসব জানা না-জানায় কিচ্ছু যায় আসে না। জায়গাটা আমাদের এত পছন্দের এবং এত ভাললাগে কেন জান?’
‘কেন?’
‘এখানে আমরা মাঝে-মাঝে আসি বলে। প্রতিদিন এলে কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাস করলে ভাললাগার এমন অনুভূতি থাকত না।’
‘তুমি বলেছ, বিয়ের পর নিয়মিত এখানে বেড়াতে আসতে চাও?’
‘সেটা এখনও চাই। মত থেকে একটুও তো নড়িনি!’
‘এত দুর্বোধ্য আর কঠিন করে বলছ কেন!’
‘প্রশ্নটা সহজ কিংবা কঠিনের না। আমরা মাঝেমধ্যে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাই, হারিয়ে আনন্দ পাই। কারণ আমাদের দুজনের পরিবারই মোটামুটি সচ্ছল। তা না হলে আজকের সৌন্দর্যও ফিকে ঠেকত।’
‘হয়েছে, তোমার দর্শনের কপচানি থামাও। কোথায় দুই একটা রোমান্টিক বুলি আওড়াবে, তা না করে অর্থনীতির তত্ত্ব নিয়ে মেতে উঠেছ।’
একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসে সবুজ ঘাসের ওপর। কিছুক্ষণ পর আরেকটা। পাশাপাশি বসে তারা ডানায় মৃদু আলোড়ন তোলে। নিজস্ব ভাষায় কথা বলছে কিনা কে জানে! প্রজাপতি দুটির দিকে চোখ যায় মারুফের। অনুসরণ করে তৃণার চোখও। মারুফ ভাবে, কী সুন্দর এ প্রকৃতি, কী দারুণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, কী চমৎকার এ বেঁচে থাকা। ভাবনা অনুরণিত হয় তৃণার মাঝেও।
সকাল থেকে সমুদ্রসৈকত দর্শনে হালকাভাবে মানুষ এলেও এখন আসতে শুরু করেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। জ্যামিতিক হারে মানুষ বেড়েই চলেছে। মানুষগুলোকে বয়ে আনা যানগুলোর প্যাঁপু শব্দে স্বাভাবিকতা এবং চারদিকের নিস্তব্ধ সৌন্দর্য হারাতে বসেছে।
তৃণা বলে, ‘চলো, এবার বিচের দিকে যাই। সকাল থেকে তো একবারও যাওয়া হয়নি।’
মারুফ ওঠে। প্যান্টে জমা ধুলোবালি হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে। আজ সৈকতে উপস্থিতি অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই। মানুষের সাহচর্যেই বোধহয় যে কোন জায়গা প্রাণ পায়। সৈকত আজ আরও বেশি সুন্দর যেন।
পাড়ে রাখা পাথর খণ্ডের ওপর দুজন পাশাপাশি বসে। সাগরে ঢেউয়ের দাপাদাপি। বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালার দাপটে সৈকতে হাঁটাহাঁটি করা মানুষ এবং সৈকতকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীরা উপরে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছে। হঠাৎ একটা ঢেউ প্রায় অর্ধেকটাই ভিজিয়ে দেয় মারুফ-তৃণাকে। তারা বসে থাকে নির্বিকার। দিক না ভিজিয়ে! ভেজা পানিতে শিহরণ, সুখ সুখ ভাব ছুঁয়ে যায়। পশ্চিমাকাশে গাঢ় লালিমা। মারুফ তৃণার একটা হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, ‘সোনা, দ্যাখোÑএ আলোকেই কি বলে প্রহর শেষের রাঙা আলো?’
তৃণা হাসেÑ‘যাহ, আলো আবার রাঙা হয় নাকি!’
‘হবে না কেন! রবীন্দ্রনাথ নিজেই যখন বলেছেন!’
‘রবি যখন বলেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত করবে এমন বাঙালী আছে নাকি!’
মনে জমে থাকা ক্লেদ, যাবতীয় দুঃখবোধ, গ্লানি সাগর বয়ে নেয়। সাগর কোন অপবিত্রতা ধারণ করে না। করতে দেয়ও না।
তৃণা আঁজলা ভরে পানি নিলে সেখান থেকে কিছু পানি মারুফ ছিটিয়ে দেয় ওর মুখে। লবণাক্ত পানি স্নাত তৃণার মুখে বাসা বাঁধে কিশোরীসুলভ আবেশ।
মারুফ বলে, ‘জলবিহার করবে?’
অবাক করে দিয়ে পলকেই পানিতে ডুব দেয় তৃণা।সূর্য ছড়িয়ে যাচ্ছে বেলা শেষের বিদায়ী আলো।
শীর্ষ সংবাদ: