ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ৪ ডিসেম্বর ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ নয় মাসের সম্মুখ সমর। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াই। তারপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে চূড়ান্ত বিজয়। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকাতে আত্মসমর্পণ করে বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। প্রতিবারের মতো এবারও সেইসব স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিতে এসেছে ডিসেম্বর। আজ দেশ নিয়ে কী এক কাড়াকাড়ি অবস্থা! অথচ জাতির মহাসঙ্কটের কালে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে পড়ার মতো লোকের বড়ই অভাব ছিল। এই যে এখন ধর্মীয় মৌলবাদীরা কথায় কথায় বাংলাদেশকে শুধুই মুসলমানের বলে প্রচার করছে, একাত্তরে তারা কোথায় ছিল? গাল ভরে কথা বলা লোকটি, বুড়ো বাবুটি, বাবু নগরীটি যুদ্ধে গিয়েছিল? না। আর মামুনুল নামের বালকটি, চিৎকার করে যে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলছে, তার এত জোস শরীরে আসে কোথা থেকে? তার পূর্বপুরুষ, তার প্রয়াত পিতাটি কি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনভাবে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন? চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, না। দেশের জন্মের সময় কোন অবদান যারা রাখেনি, বিরোধিতা করেছে তারা এখন অনুকূল সময়ে দেশের মালিক বনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সঙ্গীত নৃত্য সিনেমা চারুকলা সাহিত্য কবিতা কিছুতেই রুচি হয় না। নারীকে দাসী করে পায়ের কাছে বসিয়ে রাখার প্রাচীন লক্ষ্যে স্থির হয়ে আছে। অন্য ধর্মের মানুষ অন্য মত ও পথের মানুষ, মামুনুলদের বুলি শুনে মনে হয়, মানুষ না। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালী যা কিছু অর্জন করেছে, সবই নষ্ট করে দিতে চায়। উগ্র অসহিষ্ণু গোষ্ঠীটি ক’দিন পরপরই নানা অজুহাতে মাঠ গরম করার চেষ্টা করে। বর্তমানে তারা কামড়ে খেতে এসেছে কংক্রিটের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের মধ্যেই নাকি বেহেস্ত-দোযখ লুকিয়ে আছে। মানুষের প্রতি সমাজের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করতে এরা শেখেনি। কোভিডের কালে হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কাউকে। বরং ধর্ম ব্যবসা থেকে যা আয়, তা-ই দিয়ে দিব্যি আছে। সুখে থাকলে ভূতে তো পাবেই। হয়তো তাই বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে চিহ্নিত গোষ্ঠী। বলার অপেক্ষা রাখে না, একই চিন্তা থেকে এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। রাজাকার আলবদরদের শীর্ষ কয়েকজনের নাম হয়তো জানতে পেরেছি আমরা। সন্দেহাতীতভাবে প্রামাণিক যোদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়া ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে কখনই কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে মামুনুল গং। এখন স্বাধীনতার মহানায়ককেই তারা কৌশলে অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় ফুসে উঠেছে ঢাকা। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা দেয়া ধর্মীয় উন্মাদদের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে। ভাবতে ভাল লাগে, এই প্রতিবাদ প্রতিরোধের ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হলো এবারের ডিসেম্বর। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মাঠে নেমে এসেছে। প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে উগ্রবাদীদের। বিজয়ের মাসে এমন জেগে ওঠা আশাবাদী করে বৈকি। কোভিডের কারণে অনেক কিছুই বন্ধ রয়েছে। একই কারণে সীমিত আকারে উদ্যাপিত হবে বিজয় দিবস। উৎসব অনুষ্ঠানে অন্যান্য বছর যেমন মুখরিত থাকে ঢাকা, এবার অতটা হবে না। তবে তারও আগে যে প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত হয়েছে তা দ্বিগুণ তিনগুণ হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। অবশ্য যখন ভাস্কর্য রক্ষায় তীব্র আন্দোলন আমরা দেখছি তখনও ঢাকার অনেক ভাস্কর্য অযত্নে অবহেলায় বিনষ্ট হচ্ছে। বেশিরভাগ শিল্পকর্মে বাঙালীর সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনকের উপস্থাপনা। সড়ক দ্বীপের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে মানুষ। কিন্তু কী তারা দেখছে? ঢাকার ভাস্কর্যগুলো খেয়াল করলে মন খারাপ হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধুলোবালির স্তর পড়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে রং। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্যের এখানে ওখানে ভাঙা। এই যেমন বঙ্গবাজার এলাকার ‘প্রত্যাশা’ ভাস্কর্যটির কথা উল্লেখ করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী আনোয়ার পাশা ভবন সংলগ্ন সড়কদ্বীপে নির্মাণ করা শিল্পকর্মে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মৃণাল হকের গড়া ভাস্কর্যটি অযত্নে অবহেলায় এমন বিকৃত হয়েছে যে, তাকানো যায় না। এত গর্বের ইতিহাস এভাবে কেউ তুলে ধরে? দায়িত্বশীলদের কারও কি চোখে পড়ে না? চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি ইতোমধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর পরিচর্যার আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে ভাস্কর্য রক্ষার আন্দোলন কোন না কোন জায়গায় গিয়ে মার খাবে। নিশ্চয়ই আমরা কেউ তা চাই না। এবার অন্য প্রসঙ্গ। ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করল বাংলা একাডেমি। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কবি সাহিত্যিক শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা একাডেমি প্রাঙ্গণে সমবেত হয়েছিলেন। অন্য বছরের মতো বড় সমাবেশ ঘটেনি। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রবীণ সদস্যদের অনেকেই ছিলেন অনুপস্থিত। তারপরও যারা এসেছিলেন, বেশ আনন্দঘন সময় কাটিয়েছেন। একে অন্যের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেছেন। দেখা গেছে ছবি তুলতে। মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় বেলা ১১টায়। এ সময় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘সবার আগে সংস্কৃতি সবার সঙ্গে সংস্কৃতি’ শীর্ষক বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বক্তৃতা-২০২০ প্রদান করেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। একক বক্তৃতায় তিনি বলেন, সংস্কৃতি আপনি গড়ে উঠে, সংস্কৃতিকে বানানো যায় না। যা কিছু বাঙালী সংস্কৃতির প্রতিকূল, তার স্থান এখানে হবে না। পূর্ববাংলার মানুষ তার সংস্কৃতির কারণেই পাকিস্তানকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি বলে একক বক্তৃতায় উল্লেখ করেন তিনি। অন্য বক্তারা বলেন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যতদিন বাংলাদেশ স্থিত থাকবে, ততদিনই বাংলা একাডেমি তার প্রকৃতি মহিমায় উজ্জ্বল থাকবে। ‘সবার ঢাকা’ এ্যাপের কথাও বলা চাই। নতুন এ মোবাইল এ্যাপ চালু করছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এটি ব্যবহার করে ঘরে বসেই পাওয়া যাবে নাগরিক সেবা। যে কোন দুর্ভোগের কথা, অভিযোগের কথা মেয়রের কাছে জানানো যাবে সহজেই। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে সেবাদান শুরু হবে। কয়েকদিন আগে মেয়র আতিকুল ইসলাম এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, এ্যাপের মাধ্যমে বাসায় বসে বিভিন্ন নাগরিক সেবা নেয়া যাবে। একইভাবে যে কোন অভিযোগ তুলে ধরা যাবে। যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানান তিনি।
×