ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল

প্রকাশিত: ২৩:০২, ৪ ডিসেম্বর ২০২০

আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস এলাকায় স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের মামলায় প্রধান আসামি সাইফুরসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মোঃ আবুল কাশেমের আদালতে এ চার্জশীট জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। জানা গেছে, চার্জশীটে মামলার ছয় আসামিকে সরাসরি ধর্ষণে জড়িত এবং দুজন সহায়তা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্ষণে সরাসরি অভিযুক্তরা হলোÑ সাইফুর রহমান, শাহ মোঃ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মোঃ রবিউল হাসান ও মাহফুজুর রহমান মাসুম। অন্যদিকে ধর্ষণে সহযোগিতার জন্য আসামি করা হয়েছে মোঃ আইনুদ্দিন ও মিসবাউল ইসলাম রাজনকে। ঐ রাতেই ছাত্রাবাসে সাইফুর রহমানের (২৮) কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে একটি পাইপগান, চারটি রামদা, দুটি চাকু জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় শাহপরান থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়। মামলার তদন্তে ওই অবৈধ অস্ত্রগুলোর সঙ্গে সাইফুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান রনির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অস্ত্র আইন মামলায়ও আরেকটি চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। ধর্ষণের ঘটনার দুই মাস পর গত ২৯ নবেম্বর অভিযুক্ত আট আসামির ডিএনএ রিপোর্ট তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এসে পৌঁছে। ডিএনএ রিপোর্টে ছয়জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। এর আগে গত ১ ও ৩ অক্টোবর দু’দিনে এ মামলায় গ্রেফতার আটজনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের পর ঢাকায় সিআইডির বিশেষায়িত ল্যাবে তা পরীক্ষা করা হয়। ধর্ষণ মামলা দায়েরের পর র‌্যাব ও সিলেট জেলা পুলিশের অভিযানে আটক আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর সকলেই পাঁচদিন করে রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এছাড়াও গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সার্টিফিকেট বাতিল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিস্কারও করা হয়েছে। বহিস্কৃতরা হলোÑ সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান। গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত আট আসামি হলোÑ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার উমেদনগরের রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), হবিগঞ্জ সদরের বাগুনীপাড়ার মোঃ জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মোঃ মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), জকিগঞ্জের আটগ্রামের কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৫), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুর (জগদল) গ্রামের বাসিন্দা ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এমসি কলেজ শাখার সভাপতি রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাটের গাছবাড়ি গ্রামের মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), মিসবাউল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন আইনুল। এদের মধ্যে রাজন ও আইনুদ্দিন ছাড়া অপর ছয়জন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তদন্তকালে এ দুজনের সংশ্লিষ্টতাও পায় পুলিশ। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের বালুচর এলাকার এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই গৃহবধূ (২৫)। করোনার কারণে বন্ধ থাকা ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়। এরপর তাদের মারধর করে টাকাপয়সাও ছিনিয়ে নেয় ধর্ষকরা। ওই রাতেই নির্যাতিতার স্বামী বাদী হয়ে নগরীর শাহপরান থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। জনমতের চাপ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ধর্ষণবিরোধী আইনও সংশোধন করে সরকার। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে নববিবাহিত স্ত্রীকে প্রাইভেটকারে করে শাহপরান মাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন নগরের দক্ষিণ সুরমার জৈনপুর এলাকার এক যুবক। ফেরার পথে সন্ধ্যার দিকে টিলাগড়ে এমসি কলেজের মূল ফটকের সামনে থামেন তারা। এ সময় কয়েকজন তরুণ এসে ওই যুবকের স্ত্রীকে ঘিরে ধরেন। একপর্যায়ে প্রাইভেটকারসহ ওই যুবককে সস্ত্রীক বালুচরে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে যান তরুণরা। এরপর যুবককে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে প্রাইভেটকারের মধ্যেই ধর্ষণ করে ৫/৬ জন। পরে এই দম্পতিকে মারধর করে তাদের কাছে থাকা টাকাপয়সা, স্বর্ণালাঙ্কার ছিনিয়ে নেয় ধর্ষকরা। আটকে রাখে প্রাইভেটকারও। ছাত্রাবাস থেকে ছাড়া পেয়ে টিলাগড় পয়েন্টে এসে পুলিশকে ফোন করেন নির্যাতিতার স্বামী। পরে পুলিশ গিয়ে ছাত্রাবাস থেকে ওই দম্পতির প্রাইভেটকার উদ্ধার করে এবং নির্যাতিতা তরুণীকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করে। তবে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায় অভিযুক্তরা। ওই রাতেই ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৩/৪ জনকে আসামি করে শাহপরান থানায় মামলা দায়ের করেন নির্যাতিতার স্বামী। ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে এমন ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। দায়ীদের বিচার ও নারী নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ। মামলা দায়েরের পর আসামিরা পালিয়ে গেলেও ঘটনার তিনদিনের মধ্যে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে এজাহারভুক্ত আসামি সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম এবং সন্দেহভাজন আসামি মিসবাউর রহমান রাজন ও আইনুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কোন পদে না থাকলেও গ্রেফতার হওয়া সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে স্থানীয় ও কলেজ সূত্রে জানা যায়। করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাস বন্ধ থাকার কথা। অথচ ছাত্রাবাস খোলা থাকা এবং সেখানে ন্যক্করজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে ২৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। ১০ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। তবে সেটি প্রকাশ করা হয়নি। এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) মোঃ শাহেদুল খবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয় ১ অক্টোবর। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালক গোলাম রাব্বানীকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ কার্যদিবসে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। গণধর্ষণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ। ১৯ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ওই বেঞ্চে দাখিল করা হয়। এসব তদন্ত কমিটির কোনটির প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়নি। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ১২ অক্টোবর সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিল করে। নববধূ ধর্ষণের বর্বর ঘটনার পর দুই রাত ও একদিন পর্যন্ত আত্মগোপনে ছিলেন মামলার এজাহারনামীয় ছয় আসামি। এর ঠিক পরবর্তী মাত্র ১৬ ঘণ্টায় ধরা পড়ে এজাহারনামীয় পাঁচ আসামি। এর মধ্যে চারজনকে এমসি কলেজের এক ছাত্রলীগ নেতার ফোন নম্বর ট্র্যাক করে গ্রেফতার করা হয়। এমসি কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতার ফোন নম্বর ট্র্যাক করে চার আসামির অবস্থান শনাক্ত হয়। এরপর কয়েকটি ঝটিকা অভিযানে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। শুক্রবার ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য রাতেই জানাজানি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। শনিবার সকালে এ ঘটনায় মামলা হয়। শনিবার সকাল আটটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত- এই তিন ঘণ্টায় এমসি কলেজের এক ছাত্রলীগ নেতার মুঠোফোন নম্বরে অসংখ্যবার কল আসে। এতে পুলিশের সন্দেহ হয়। পুলিশ তার মুঠোফোন নম্বর ট্র্যাক করে। অতপর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের অবস্থান শনাক্ত হয়। পরে একে একে ধরা পড়েন এজাহারভুক্ত চার আসামি। রবিবার রাতে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয় আসামি রবিউল হাসানকে (২৮)। পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বিশেষ নির্দেশনা, গোয়েন্দা ও পুলিশ বিভাগের সমন্বিত অভিযানে রবিউলের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। রাত নয়টা থেকে ১০টার মধ্যে শনাক্ত করা স্থান থেকে রবিউল গ্রেফতার হয়। রবিউলের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের জগদল গ্রামে। গ্রেফতার এড়াতে সে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কাজীগঞ্জ বাজারের নিজআগনা গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়িতে আত্মগোপন করেছিল। হবিগঞ্জে রবিউলকে ধরার প্রায় আধা ঘণ্টা আগে র‌্যাব-৯ আরেক অভিযানে জেলার শায়েস্তাগঞ্জ থেকে শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনিকে গ্রেফতার করে। তার বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামে। এর আগে হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল পলাতক আরেক আসামি অর্জুন লস্করকে গ্রেফতার করে। অর্জুনকে গ্রেফতার করার আগে সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে গ্রেফতার হয় প্রধান আসামি সাইফুর রহমান। খেয়াঘাট থেকে দোয়ারাবাজার যাওয়ার পথে গ্রেফতার হয়। এদিকে, যে ছাত্রলীগ নেতার ফোন নম্বর ট্র্যাক করে চার আসামিকে পাকড়াও করা হয় সে ছাত্রলীগ নেতাই টিলাগড় ও এমসি কলেজ এলাকায় অভিযুক্তদের শেল্টার দিতেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। ওই ছাত্রলীগ নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই রবিউল-সাইফুররা অত্র এলাকায় নৈরাজ্য আর অরাজকতা চালাত বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি কোন আইনজীবী। মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমান এবং আরেক আসামি অর্জুন লস্কর এবং রবিউল ইসলামকে সিলেট মহানগর হাকিম-২ আদালতে হাজির করা হলে আসামিপক্ষে কোন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের বক্তব্য প্রদান করে এবং আসামিরা নিজেরাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। তিন আসামিই আদালতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বলে জানা গেছে। রিমান্ড শুনানিকালে আসামি সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্করের পক্ষে কোন আইনজীবী উকালত নামা আদালতে দাখিল করেননি। শুনানিকালে আদালতের বিচারক সাইফুর ও অর্জুনের পক্ষে কোন আইনজীবী না পেয়ে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা দুজন আদালতকে জানায়, ছাত্রাবাসের ঘটনার সঙ্গে আমরা জড়িত নই। আমরা কোন অপরাধ করিনি। এই ঘটনা ঘটিয়েছে রাজন, তারেক ও আইনউদ্দিন। তাদের বক্তব্য শুনার পর পরই আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাদী পক্ষের হয়ে শুনানিতে অংশ নেয়া এ্যাডভোকেট ইফতেখার আলম শোয়েব বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ২ আসামির বিরুদ্ধে। এ সময় আদালতের এজলাসে উপস্থিত আইনজীবী কয়েকজন পুলিশের রিমান্ড আবেদনের সঙ্গে একমত পোষণ করে আদালতে যুক্তি দেখান। পরে আদালত তাদের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এমসি কলেজ শাখার সভাপতি রবিউল হাসান ও তার সঙ্গীরা সিলেট এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে নানা ধরনের অপকর্ম করে বেড়াত। আদাব সালাম না দিলে শিক্ষার্থীদের মারধর করে আহত করত রবিউল। শুধু তাই নয়, মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তা ফাঁকা পেলেই নারী শিক্ষার্থীদের ওড়না ধরে টান মারা, মদ-জোয়া, ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, বিনা কারণে শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছনা, হোস্টেলে জোরপূর্বক বসবাস, মিল না দিয়ে বন্ধুবান্ধবসহ খাওয়া, হোস্টেলের সিট বিক্রিসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল রবিউল। জানা যায় রবিউল ও তার সহযোগীরা টিলাগড়সহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চাঁদা আদায়, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই ধরে নিয়ে মারধর করা হতো এবং এমনকি হত্যার হুমকিও দেয়া হতো। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনার মূলহোতা ছাত্রলীগ ক্যাডার সাইফুর রহমান ও শেখ মাহবুবুর রহমান রনি ক্যাম্পাসে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। শিক্ষক, সাধারণ শিক্ষার্থী, নিজ দলের কর্মী ও কলেজের পাশর্^বর্তী টিলাগড় এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ত্রাস ছিল তারা। সাইফুর ও রনির ইভটিজিং ও নির্যাতনের শিকার হয়ে কলেজ ছেড়েছেন অনেক ছাত্রী। ক্যাম্পাসে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কলেজে বেড়াতে আসা তরুণীদের ধর্ষণ ছিল তাদের নৈমিত্তিক কাজ। ক্যাম্পাসে আধিপত্য থাকায় দলের ‘বড় ভাই’দের কাছেও বিশেষ কদর ছিল তাদের। আর নির্যাতনের ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গণধর্ষণের ঘটনার পর ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে সাইফুর-রনি ও তাদের সহযোগীদের নানা অপকর্মের কাহিনী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে প্রতিদিন বিকেলে শত শত তরুণ-তরুণী বেড়াতে আসেন ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে। অনেকে ঘুরতে ঘুরতে ক্যাম্পাসের নির্জন এলাকায় চলে যান। এ রকম জায়গায় কোন দম্পতি বা প্রেমিকজুটিকে পেলে সাইফুর ও রনি তাদের সহযোগীদের নিয়ে চড়াও হতো। আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করত তারা। ছিনতাই করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতেরও ঘটনা ঘটেছে বহুবার। সন্ধ্যার পর বা রাতে ক্যাম্পাসে প্রেমিকজুগল পেলে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সাইফুর-রনি চক্র তাদের তুলে নিত পাশর্^বর্তী ছাত্রাবাসে। সেখানে নিয়ে ধর্ষণ করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেয়া হতো। আত্মসম্মানের ভয়ে কেউই মুখ খুলতেন না। রাতে টিলাগড়-বালুচর সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী লোকজনকে ছাত্রাবাসে ধরে এনে নির্যাতন ও ছিনতাই করত তারা। এসব অপকর্মে সাইফুর ও রনির সহযোগী ছিল গণধর্ষণ মামলার আসামি অপর চার ছাত্রলীগ ক্যাডার তারেক, রবিউল, মাহফুজ ও অর্জুনসহ আর কয়েকজন। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসকে কেন্দ্র করে সাইফুর ও রনি তাদের টর্চার সেল গড়ে তুলে। হোস্টেল সুপারের বাংলো দখল করে থাকত সাইফুর। ভয়ে অন্যত্র থাকতেন হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন। হোস্টেলের নতুন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষ ও বাংলোতে সাইফুরের নেতৃত্বে বসানো হয় ‘শিলং তীর জুয়া’র আসর। এছাড়া প্রতিদিন রাতে বসত মাদকের আসর। করোনা পরিস্থিতির কারণে হোস্টেল বন্ধ থাকায় নিজের দখলে থাকা হোস্টেলের রুমকে মাদক সেবন ও ইয়াবা ব্যবসার আখড়ায় পরিণত করে সাইফুর। ২০১৩ সালে কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সময় চাঁদাবাজি শুরু করে সাইফুর ও তার সহযোগীরা। এতে বাধা দেয়ায় নিজ দলের কর্মী ছদরুল ইসলামের বুকে ছুরিকাঘাত করে সাইফুর। গুরুতর আহত ছদরুলকে সিলেট থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। পরে নেতাদের চাপে ছদরুল বাধ্য হয় মামলা আপোস করতে। সূত্র জানায়, কলেজে মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দিত রনি। জোর করে সে ছাত্রীদের মোবাইল নাম্বার নিত। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে সে প্রকাশ্যে তাদের লাঞ্ছিত করত। রনির নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ছাত্রী কলেজ ছেড়ে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রায় আড়াই বছর আগে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে রনি। কিন্তু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায় সে। শাহ রনি ও তার সহযোগী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি তারেক নিজেদের র‌্যাব-পুলিশ পরিচয় দিত বলেও অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশ পরিচয় দিয়ে রাস্তা থেকে লোকজন অপহরণ করে ছাত্রাবাসে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া সাইফুর ও রনি চক্রের হাতে ক্যাম্পাসে একাধিকবার সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। ধর্ষকদের সহযোগী ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের খুঁজে বের করার দাবি ॥ সিলেটের মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের ধর্ষকদের সহযোগী ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছে সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নাগরিকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্ম ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’র পক্ষ থেকে বলা হয়, এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে যারা এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটিয়েছে তারা একদিনে এ রকম বেপোরোয়া হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এ রকম অপকর্ম ঘটিয়ে আসছে। এই একই গোষ্ঠী এমসি কলেজের ছাত্রাবাসেও অগ্নিসংযোগ করে। মারামারী ও খুনাখুনী তাদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠে। যে কারণে টিলাগড়-বালুচর এলাকা হয়ে উঠেছে নগরবাসীর আতঙ্কের নাম। রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয় আর আস্কারা পেয়েই ছাত্রলীগ নামধারী দুর্বৃত্তরা একের পর এক অপকর্ম ঘটিয়ে চলছে। যা ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজসহ পুরো সিলেটকেই কলঙ্কিত করছে। আমরা মনে করি, কেবলমাত্র ধর্ষণে সরাসরি সম্পৃক্তদের বিচারের আওতায় আনলেই এই এলাকার অপরাধ ও অপকর্ম বন্ধ করা যাবে না। বরং গডফাদারদের ছত্রছায়ায় নতুন নতুন অপরাধী তৈরি হবে। এজন্য আমরা প্রথম থেকেই টিলাগড় এলাকার গডফাদারদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছি। বিবৃতিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার ছাত্রাবাসে ধর্ষণের মামলায় অভিযোগপত্র প্রদান করেছে পুলিশ। কিন্তু এই অভিযোগপত্র আমাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ডিএনএ রিপোর্ট নির্ভর একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। এতে পুলিশের নিজস্ব তদন্তের কোন ছাপ নেই। আসামিরা কাদের সহযোগিতায় পালাল, কারা তাদের আত্মগোপনে সহায়তা করেছে, কাদের সহযোগিতায় বন্ধ ছাত্রাবাসে তারা আস্তানা গড়ে তুলল- এসব ব্যাপারে অভিযোগপত্রে কিছু উল্লেখ নেই। ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’ সংগঠকরা বলেন, আমরা মনে করি এটি একটি অসম্পূর্ণ অভিযোগপত্র। পুলিশ ধর্ষকদের নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের আড়াল করার চেষ্টা করেছে। চাঞ্চল্যকর এই মামলার সম্পূরক চার্জশীট প্রদান করে গডফাদারদের চিহ্নিত করার দাবি জানানো হয়।
×