ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার মাসেই লক্ষ্যমাত্রার ৭৮ শতাংশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি

প্রকাশিত: ১৮:৫০, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

চার মাসেই লক্ষ্যমাত্রার ৭৮ শতাংশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা সংস্থানের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি থেকে সরকার ১৫ হাজার ৬৪২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা সংগ্রহ করে ফেলেছে। এটি পুরো অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৮ দশমিক ২১ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা উচ্চসুদের সঞ্চয়পত্র কেনায় ঝোঁক বাড়িয়েছেন। আর সরকারও কম সুদের ব্যাংকঋণের পরিবর্তে ব্যয়বহুল সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বাজেট ঘাটতি মেটাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের চার মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বাড়লেও এ সময়ে সরকারের ব্যাংকঋণ উল্টো কমেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বা ১০ হাজার ৩৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বেড়েছে। আগের অর্থ বছরের একই সময়ে যা ছিল ৫ হাজার ৫১২ কোটি ২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি হয়েছে ৩৭ হাজার ১৯৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং ২১ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ টাকা মূল টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির বিদ্যমান প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে অর্থ সংগ্রহে সরকারের যে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি অক্টোবরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ২১১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯০ শতাংশ বেশি। গত বছরের অক্টোবরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ৮২২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছিল সরকার। চলতি অক্টোবরে মোট ৯ হাজার ২৪৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে এবং সঞ্চয়পত্রের মূল অর্থ বাবদ ৫ হাজার ২১৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। মূলত নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষ ঝুঁকছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, হঠাৎ করে ধারাবাহিকভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের বড় উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। আগে কেনা হলেও, এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় এই অঙ্ক বেড়েছে। আহসান এইচ মুনসুর আরও বলেন, আগে ব্যাংকে আমানত রাখলে ৭ বা ৮ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত কিন্তু এখন সেটা ৫ শতাংশে নেমে গেছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে ১১ বা ১২ শতাংশ দেওয়া হয়। এখানে বিশাল তফাৎ হয়ে গেছে। বিক্রির সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া না হলে মাসে ২০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র বিক্রি হতো। আর সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় প্রবাসীরা আগের তুলনায় বেশি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে। সেই টাকাও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে। কারণ, বাইরের দেশে কোনো সুদ দেওয়া হয় না। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদ দেওয়া হয়। ফলে রেমিট্যান্সের টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে। জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার পর ব্যাংক আমানতের সুদের হার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কোনো কোনো ব্যাংকে আমানতের সুদ হার ২ শতাংশেরও কম দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। যেখানে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে এখনো ১৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। সঞ্চয়পত্রে ১০ শতাংশ হারে কর প্রদানের পরও এখানে বিনিয়োগ বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় এবং দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো মেঘাচ্ছন্ন থাকায় বিভিন্ন সংস্থা তাদের তহবিল ব্যাংকে রাখার চেয়ে নিরাপদ ও উচ্চ আয়ের স্কিমে রাখতে উৎসাহিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়তে দেখা যায়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়লেও তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের কম সুদের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩৫ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৪৫ কোটি টাকা কম ঋণ নিয়েছে সরকার। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৩৫৩ দশমিক ৫ কোটি টাকা, যা অক্টোবর শেষে ২০ হাজার ৪৭ দশমিক ৪৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব থেকে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে।
×