ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘জুম’ দিয়ে বিশ্বজয়ের গল্প

প্রকাশিত: ১৪:৪১, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

‘জুম’ দিয়ে বিশ্বজয়ের গল্প

অনলাইন ডেস্ক ॥ মার্চের মাঝামাঝি এক সোমবার সকালবেলা। ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলগুলো মাত্রই অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। এরিক ইউয়ানের মেয়ে প্রথমবারের মতো নতুন রুটিন অনুযায়ী ক্লাস করতে বসছিল। একসময় সে পেছনে ফিরে বাবাকে জুম ব্যবহারে সাহায্য করতে বলে। ইউয়ান বলেন, ‘সে আমাকে কখনোই জুম নিয়ে প্রশ্ন করত না। আমরা যখন জুম তৈরি করি, লক্ষ্য ছিল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক ক্রেতাদের সেবা দেয়া। কখনোই ভাবিনি, আমার সন্তানকেও জুম ব্যবহার করতে হবে।’ ওই মুহূর্তেই জুমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এরিক ইউয়ান বুঝতে পারেন, তার দুনিয়া বদলাতে চলেছে। ব্যবসায়ীদের জন্য যে জিনিস তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হতে চলেছে। তবে শুরুতে কেউই জুমের এমন অবভাবনীয় সাফল্য কল্পনা করেনি। কারণ, ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে ইউয়ান বরাবরই ছিলেন আন্ডারডগ। ১৯৯৭ সালে চীন থেকে সিলিকন ভ্যালিতে পাড়ি জমান তিনি। চাকরি নেন মার্কিন সফটওয়্যার কোম্পানি ওয়েবেক্সে। সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখে ফেলেন ইংরেজি। সেসময় তার লক্ষ্য ছিল সহজে ব্যবহারযোগ্য সাধারণ একটি ভিডিওকনফারেন্স ব্যবস্থা চালু করা। কিন্তু এ নিয়ে কেউই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বিনিয়োগকারীরা বললেন, বাজারে এর জায়গা নেই। তখন নিজেকে উজ্জীবিত রাখতে কম্পিউটারের স্ক্রিনসেভারে ইউয়ান লিখে রেখেছিলেন, ‘তারা ভুল বলছে।’ তিনি বলেন, ‘আপনি যা পারেন তার সবই করতে হবে। অন্যদের ভুল প্রমাণে আপনি যতটা পারেন, ততটা কাজ করতে হবে।’ ঘটনাক্রমে ঠিক সেটাই করে দেখান এরিক ইউয়ান। ২০১৯ সালে প্রকাশ্যে আসে জুম, খুলে যায় ইউয়ানের বিলিয়নিয়ার হওয়ার দরজা। বৈশ্বিক মহামারির আগে একদিনে সর্বোচ্চ এক কোটি অংশগ্রহণকারী পেয়েছিল জুম। কিন্তু লকডাউন শুরু হলে এপ্রিলে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ কোটিতে। ইউয়ান বলেন, ‘আমিসহ জুমের প্রত্যেক কর্মী খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কারণ, বহু বছর কঠোর পরিশ্রমের পর দেখছিলাম, আমরা সত্যিই মানুষকে সাহায্য করতে পারছি।’ কিন্তু তিনি জানতেন, এই পথ কঠিন হবে। শিগগিরই প্রতষ্ঠানের রসদে টান পড়বে। একারণে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত তাদের আরও কর্মী নিয়োগ দিতে হয়। এমন সব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, যা তারা কখনো ভাবেননি বা আগে মোকাবিলা করতে হয়নি। ইউয়ান জানান, তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন- শুধু সেদিনের সিদ্ধান্তের কারণে নয়, বহু বছর ধরে কাজের যে ভিত্তি গড়েছিলেন, তার কারণে। জুম শুরুর দিকের ঘটনা প্রসঙ্গে এরিক ইউয়ান বলেন, ‘আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, আগামী ১০, ১৫ বা ২০ বছর কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চাই? জবাবটা সহজ, যেটা আমাকে খুশি করবে।’ পরে সেই অনুযায়ী কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় আমার কর্মীদের বলি, প্রত্যেক সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি খুশি নাকি না? যদি খুশি থাকেন, দ্রুত অফিসে আসেন। যদি না থাকনে, তাহলে বাসায়ই থাকতে পারেন।’ জুম প্রতিষ্ঠাতার মতে, সুখই তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূলনীতি। বর্তমানে ১০০ জনেরও বেশি ‘হ্যাপিনেস ক্রু’ রয়েছে তার। ইউয়ান বলেন, ‘আমার কর্মীদের চাপ দেয়ার প্রয়োজন নেই। তারা জানে কী করতে হবে। আমরা ব্যবসার পরিবর্তনে এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছি।’ এবছর মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বাড়তে থাকল জুমের। এরিক ইউয়ান কিছুটা সময় নিলেন তার কী আছে, কী করতে হবে- সেগুলো চিন্তা করতে। তার পণ্যের নির্মাণকৌশল শক্তিশালী এবং পরিমার্জনযোগ্য। তারপরও সমস্যা আসতে থাকে। ব্যবহারকারী বাড়ার কারণে জুমের সার্ভারের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন হলো (বর্তমানে তাদের ১৯টি ডেটা সেন্টার রয়েছে)। প্রতিদিন লাখ লাখ নতুন ব্যবহারকারী আসতে থাকল যারা জানে না জুম কীভাবে কাজ করে। তাদের জন্য ‘কাস্টোমার সার্ভিস টিম’ বাড়াতে হলো। এর মধ্যে যোগ হলো নিরাপত্তা হুমকি। জুম অ্যাপে অনেক বাগ ছিল, এর মধ্যে একটিতে হ্যাকাররা অন্যদের আলাপে আড়ি পাততে পারত বা মিটিংয়ে ঢুকে যেতে পারত। এর নাম দেয়া হলো ‘জুম-বোম্বিং’। এর কারণে তখন বড় বড় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা জুম ব্যবহার বন্ধ করে দিল। সবখানে মাধ্যমটিকে নিয়ে নেতিবাচক খবর ছড়াতে থাকল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ভেতর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই সাধারণ- দ্রুত সমাধান, কোনও কিছুই গোপন নয়। তাদের মতে, নিরাপত্তা হুমকি কাটিয়ে ওঠা যায়, কিন্তু তথ্য গোপন করলে প্রতিষ্ঠানের জন্য তার ফল হবে ভয়াবহ। এরিক ইউয়ান বলেন, ‘জুম ব্যবহারকারীরা অনেক বুদ্ধিমান। আপনি যদি সবকিছু উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ রাখেন, তাহলে তারা দ্রুত বুঝে যাবে, জুম এমন একটা প্রতিষ্ঠান যাকে বিশ্বাস করা যায়।’ সংকট কাটাতে ১ এপ্রিল থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত কর্মীদের বিশেষভাবে জুমের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়টিতে নজর দিতে বললেন ইউয়ান। তারা দ্রুত জুমের বাগগুলো শনাক্ত করেন এবং ব্যবস্থা নেন। জুনে নতুন চিফ ইনফরমেশন সিকিউরিটি অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়, সঙ্গে রাখা হয় নতুন আরও অনেক সিকিউরিটি ইঞ্জিনিয়ারকে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে ছিল থার্ড-পার্টি বিশেষজ্ঞও। শুধু নিরাপত্তাই নয়, প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যেকোনও প্রশ্ন জানতে সাপ্তাহিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে জুম। নিজস্ব ব্লগে নিয়মিত তথ্য দেয়াও শুরু হয়। ফলে মে মাস নাগাদ নিউইয়র্ক সিটির স্কুল ডিপার্টমেন্টসহ আরও অনেকেই জুমে ফিরে আসে। অর্থাৎ, ইউয়ানের কৌশল কাজে লেগেছিল। উন্নতির এই ধারায় আরও কিছু উদ্যোগ নেয় জুম। আগস্টে নতুন ফিল্টার, লাইটিং এবং শব্দদূষণ কমানোর নতুন ব্যবস্থা যোগ হয় ভিডিওকনফারেন্সিং মাধ্যমটিতে। সেপ্টেম্বরে ব্যবহারকারীরা একাধিক ভিডিও পিন করার সুবিধা পান। অক্টোবরে অনলাইন ইভেন্টস বিক্রি বাড়াতে আসানা ও স্ল্যাকের মতো অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় জুম। এরিক ইউয়ানের দৃষ্টিতে তার ব্যবসা এবং ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ দুটোরই ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। তার আশা, একসময় কথা বলার মধ্যেই ভাষান্তর করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ফলে ভিন্ন ভাষাভাষীরাও জুমে সরাসরি আলাপ করতে পারবেন। জুম প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারি- তেমনি সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং আবেগী বাধাও অতিক্রম করা সম্ভব। দুইজন মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, মাত্র এক ক্লিকেই পারস্পরিক বিশ্বাস তৈরি করতে এবং একে অপরকে বুঝতে পারবে।’ সূত্র: এন্ট্রাপ্রেনার ডটকম
×