ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুদক মরিয়া ॥ বিদেশে পাচার অর্থ ফেরত আনতে

প্রকাশিত: ২২:০৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

দুদক মরিয়া ॥ বিদেশে পাচার অর্থ ফেরত আনতে

রহিম শেখ ॥ বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি জটিল হলেও এর মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে ৫০টি দেশের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-(এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুদকের এই উদ্যোগে একদিকে যেমন পাচারকৃত বিপুল অঙ্কের অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হবে, অন্যদিকে বন্ধ হবে অবৈধ অর্থ পাচার। একই সঙ্গে কমে যাবে দুর্নীতি ও অবৈধ উপার্জনের প্রক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। অর্থ পাচার বাংলাদেশের অন্যতম জটিল সমস্যা। দেশ থেকে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত দেশের নানা পেশার মানুষ। মূলত অবৈধ পথে উপার্জিত অথবা অপ্রদর্শিত অর্থই বিদেশে পাচার হয়। অবৈধ অর্থ দেশে বিনিয়োগ কিংবা সঞ্চয় নিরাপদ মনে না করায় এই অর্থ পাচার হয়ে যায়। বাণিজ্য কারসাজি এবং হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয় এই অর্থ। এতদিন অনেকটা নিরাপদ থাকায় দিন দিন অর্থ পাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। সম্প্রতি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থ পাচার রোধে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে দুদক বিদেশে ইতোমধ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে তৎপরতা শুরু করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি বলেছেন, কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার। তার এই বক্তব্যের পর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। পাচারকৃত এসব অর্থ চিহ্নিত করা ও টাকা ফেরত আনার বিষয়টি অনেক জটিল হলেও অসম্ভব নয়। বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া এই টাকা ফিরিয়ে আনার নজিরও আছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ফেরত আনতে পেরেছিল দুদক। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে পাচার হওয়া ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত এসেছে। এবার হদিস মিলেছে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে থাকা এক বাংলাদেশীর এক বিলিয়ন ডলারের। সে টাকা ফিরিয়ে আনতে চায় দুদক। সংস্থাটি বলছে, তাদের উদ্যোগের মধ্যে এখন এগিয়ে আছে মোরশেদ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের হংকংয়ে পাচার করা ৩২১ কোটি টাকা ফেরত আনা। এছাড়া বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন এবং তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিম ও প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের পাচারের টাকা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সংস্থাটি। সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াসহ ৫০টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-(এমএলএআর) পাঠিয়েছি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবছর কত টাকা বিদেশে পাচার হয় সে সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কোন তথ্য কোথাও নেই। তবে দেশ থেকে টাকা পাচারকারীর প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও বছরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার ধারণা পাওয়া যায় মার্কিন গবেষণা সংস্থাসহ কয়েকটি বিদেশী সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ২৮৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৬ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ শীর্ষক যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত ১০ বছরে (২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা করা অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় পাঁচ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার চাইলেই পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সম্ভব। কারণ এখন আর সুইস ব্যাংক আগের মতো গোপনীয়তা রক্ষা করে না। তারা অনেক কিছুই শেয়ার করে। ফলে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসবে। আবার পাচারও অনেকাংশে কমে যাবে।’ অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর একটি বড় উপায় হচ্ছে বাণিজ্য কারসাজি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোন পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে থেকে যায়। একইভাবে রফতানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এগুলো ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং হিসেবে পরিচিত। টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল। খুব প্রচলিত হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। আমদানির ক্ষেত্রে যেটা করা হয়, কোন একটি পণ্যের দাম যত হবার কথা তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করে দেয়া হয়।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচারকৃত এসব অর্থ চিহ্নিত করা ও টাকা ফেরত আনার বিষয়টি অনেক জটিল প্রক্রিয়া। প্রথমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক পাচারকৃত অর্থ চিহ্নিত করে তদন্তের পর মামলা করতে হয়। এরপর আদালত রায় দিলেই কেবল প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফএফআই) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান জনকণ্ঠকে জানান, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা দীর্ঘ ও জটিল বিষয়। অর্থ পাচারের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে এবং তিনি যেখানে পাচার করেছেন সেখান থেকে যে কোন মাধ্যমে সঠিক তথ্যটি পেতে হবে। পাচার যে দেশে হয়েছে সেখানকার তথ্য পাওয়ার পর দুদেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পারস্পারিক তথ্য বিনিময় করবে। কিন্তু এসব গোপন তথ্য আদালতে দেয়া যায় না। তাই মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিসটেন্সের অনুরোধ করতে হয়। সেটা দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের মতো করে তথ্য আনতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘ওই অনুরোধের পর পাওয়া তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয় এবং সেটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে পাঠিয়ে সেখানকার আদালতেও ফ্রিজ বা জব্দ করাতে হয়। আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, এ পর্যায় পর্যন্ত গেলে পাচার করা অর্থ আনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবে এরপরেও দুদেশের মধ্যে সমঝোতা ও কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয় আছে।’ তিনি বলেন, ‘যে দেশে টাকা পাচার হয়েছে সেটি আদালত পর্যন্ত এলে তারপর ওই দেশ সহযোগিতা করলে টাকা ফেরত আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এজন্য জাতিসংঘ কনভেনশনের আওতায় কিছু পথ আছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সঙ্গে ৭২ দেশের এফআইইউর সমঝোতা আছে। এছাড়া এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১৬৫টি দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। আবার ট্যাক্স রিকভারির জন্য রাজস্ব বোর্ডের কিছু চুক্তি আছে। সবকিছু কাজে লাগিয়ে দেশের আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় পেলে তা যে দেশে পাচার হয়েছে সেদেশের এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে পাঠানো হয়। ওই অর্থ ফেরত দেয়া যায় কিনা সেটি নিয়ে তারা সেখানে মামলা করতে পারে এবং এরপর ওই দেশ অর্থ ফেরত দিতে কোন আইনী সমস্যা আছে কিনা তা পর্যালোচনা করে। যদি পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনী জটিলতা না থাকে, সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।’ আর এসব কারণেই বিষয়টি অনিশ্চিত, জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী বলে জানান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান। পাচার হওয়া অর্থ মামলা ছাড়া ফেরত আনা সম্ভব কি-না জানতে চাইলে বিএফএফআই প্রধান বলেন, ‘এটি সম্ভব, যদি উভয় দেশে এ নিয়ে কোন আইনী জটিলতা না থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। বাংলাদেশ এই এগমন্ড গ্রুপের সদস্য। এ ক্ষেত্রে এক দেশের এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অন্য দেশের এ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট নম্বরসহ কিছু তথ্য সরবরাহ করতে হবে। এটি পাওয়ার পর ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তথ্য যাচাই-বাছাই করবে এবং তাতে কোন তথ্যে গরমিল না পেলে কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।’ জানা গেছে, ২০১২ ও ২০১৩ সালে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে ২১ কোটি ৫৫ হাজার টাকা তিন দফায় দেশে ফেরত আনা হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালের নবেম্বরে প্রথম দফায় ২০ লাখ ৪১ হাজার ৫৩৪ দশমিক ৮৮ সিঙ্গাপুরের ডলার দেশে ফেরত আনে দুদক যা বাংলাদেশী টাকায় ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি ২৩ হাজার ৮০০ সিঙ্গাপুরি ডলার যা বাংলাদেশী প্রায় ১৫ লাখ টাকা আনে দুদক এবং একই বছরের ১৩ আগস্ট সিঙ্গাপুর ওভারসিস ব্যাংক থেকে আরও নয় লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৭ মার্কিন ডলার বাংলাদেশে পাঠানো হয়। বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ ৭ কোটি ৪৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৫ টাকা। এ অর্থ বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্স থেকে ঘুষ হিসেবে নিয়েছিলেন কোকো। জানা গেছে, কোকোর পাচারের টাকা ফেরত পেতে সরকারকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর করা মামলার রায়ে পাচারের বিষয়টি উঠে আসে। এছাড়া ফিলিপিন্স থেকে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অর্থ ফেরত এসেছে এক কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে দুই কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হওয়ার পর ফেরত আনা অর্থ রিজার্ভেই রয়েছে। আর আরাফাত রহমান কোকোর পাচারের অর্থ ফেরত এনে অর্থ পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে। অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে ৫০ দেশে চিঠি দিয়েছে দুদক ॥ বিভিন্ন ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াসহ ৫০টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-(এমএলএআর) পাঠিয়েছি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন পর্যন্ত ২২টি দেশ দুদকের পাঠানো চিঠির বিষয়ে সাড়া দিয়েছে। গত অক্টোবরে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে দুদকের সচিব মোঃ দিলওয়ার বখ্ত জানান। দুদক সচিব জানান, অর্থপাচারের তথ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশেও এ ধরনের এমএলএআর এসে থাকে। কমিশন এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি এবং সেন্ট লুসিয়া থেকে পাওয়া সাতটি এমএলএআর’র জবাব দিয়েছে বলেও জানান তিনি। সিঙ্গাপুরে হদিস মিলেছে এক বাংলাদেশীর এক বিলিয়ন ডলারের ॥ সিঙ্গাপুরে এক বাংলাদেশীর নামে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ বিপুল পরিমাণ অর্থের কোন দাবিদার নেই। তবে বাংলাদেশ ওই টাকার মালিকানা দাবি করেছে। সে টাকা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘টিটি চুক্তি অনুযায়ী এখনই নাম প্রকাশ করা যাবে না। তবে গুঞ্জন রয়েছে, ‘কোন একটি মামলায়’ এ এ্যাকাউন্টের মালিকের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তার স্ত্রী-সন্তানও আছেন, কিন্তু তারাও এ টাকার মালিকানা দাবি করতে যাচ্ছেন না। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া সহজসাধ্য নয়, যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ তবে সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ টাকার মালিক। অবশ্য এ ধারণার পক্ষে এখনও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘সাধারণত কেউ মারা গেলে তার নমিনিরা ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের মালিক হন। বাংলাদেশের মতো সিঙ্গাপুরের ব্যাংকগুলোরও একই নিয়ম। কিন্তু সিঙ্গাপুরের ওই এ্যাকাউন্টের কোন নমিনি নেই। আবার এ টাকাগুলো তার স্ত্রী বা ছেলে কেউ নিজেদের বলে দাবিও করছেন না। হয়তো তাদের আইনজীবী পরামর্শ দিয়েছেন তোমরা যদি টাকাটা নিজেদের দাবি কর তাহলে দুদক তোমাদের নামে অভিযোগ দায়ের করবে। ফলে এখন কেউ দাবি না করায় টাকাটা আনা মুশকিল হয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের আইন, সিঙ্গাপুরের আইন ও মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স আইন খতিয়ে দেখছি কীভাবে টাকাটা আনা যায়। যদিও আমরা ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর সরকারকে বলেছি এ টাকাগুলো আমাদের দেশের। কিন্তু শুধু মুখে বললেই তো হবে না, তারা এর সপক্ষে কিছু কাগজপত্র চায়।’ এ প্রসঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের টাকা যদি অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয় অবশ্যই তা ফেরত আনতে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। রাষ্ট্রের টাকা কোথাও যদি পাচার হয় তাহলে অবশ্যই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। রাষ্ট্র এবং জনগণের টাকা ফেরত আনা হবে। একই সঙ্গে এ টাকা পাচারে যুক্তদের খুঁজে বের করা হবে।’ মোর্শেদ খানের ৩২১ কোটি টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছে দুদক ॥ বিএনপির সাবেক নেতা মোরশেদ খান ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের তথ্য জানতে ২০০৯ সালে হংকংয়ে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ। মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) আওতায় দেয়া ওই চিঠির উত্তরে হংকংয়ের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা জমা ও উত্তোলনের তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেলকে দেয়া ওইসব তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজধানীর গুলশান থানায় দুদকের উপপরিচালক মোঃ মনিরুজ্জামান খানের দায়েরকৃত মামলার এজাহারের তথ্যমতে, হংকং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে মোরশেদ খান, ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানসহ তাদের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ১১টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া যায়। ২০০১ সাল-পরবর্তী সময়ে এসব ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার ৩০৫ মার্কিন ডলার। হংকং ডলারের তিনটি হিসাবে জমা হয় বাকি অর্থ। যদিও জমাকৃত অর্থের বড় অংশই বিভিন্ন সময় তুলে নিয়েছেন তারা। দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মোর্শেদ খান ও ও তার পরিবারের সদস্যদের হংকংয়ে পাচার করা ৩২১ কোটি টাকা ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১৬ কোটি টাকা ফেরত আনার জন্য হংকংয়ের এ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এছাড়া বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন এবং তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিমের টাকাও উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে দুদক। পিকে হালদারের অর্থ ফেরত আনা সম্ভব বলছে বিএফআইইউ ॥ আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারসহ ২৫ জন মিলে দেশের চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে আত্মসাত করেছেন প্রায় ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে এসব অর্থ লুট করে পাচার করা হয়েছে ভারত, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পেয়ে ইতোমধ্যে এসব অর্থ পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জনকণ্ঠকে বলেন, পিকে হালদার ফিরে না আসলে আইনগতভাবে তাকে ও তার পাচার করা অর্থ ফেরত আনা হবে। জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহাঃ রাজী হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে আমরা তখনই সাহায্য করতে পারব যখন আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে পাচার হওয়া কিছু অর্থ দেশে আনা হয়েছে। তখন আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। ওই টাকা আনতে সিঙ্গাপুরের আদালতেও আমাদের মামলা করতে হয়েছিল।’
×