ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিলাল নির্মাণে আগ্রহী দুই জাপানি কোম্পানি

প্রকাশিত: ১৯:০৮, ২ ডিসেম্বর ২০২০

মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিলাল নির্মাণে আগ্রহী দুই জাপানি কোম্পানি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরে একটি ডেডিকেটেড এলপিজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য তারা দুটি জাপানি কোম্পানির কাছ থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তবে এই প্রস্তাবগুলো মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত কোন মাপকাঠি বা ক্রাইটেরিয়া না থাকায় এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বিপিসি কিংবা জ্বালানি বিভাগ। এছাড়া প্রস্তাবিত এলপিজি টার্মিনালের জন্য কোন সম্ভাব্যতা সমিক্ষাও পরিচালনা করেনি বিপিসি কিংবা জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রয়োজনীয় যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ এবং কোন সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা ছাড়া এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে নানা জটিলতা ও ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর মাতারবাড়ির বহুমুখী ব্যবহারের সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এখানে গড়ে তোলা হবে তিনটি পৃথক টার্মিনাল। এগুলো হচ্ছে কয়লা আমদানির জন্য কয়লা টার্মিনাল, এলএনজি আমদানির জন্য এলএনজি টার্মিনাল এবং এলপিজি আমদানির জন্য এলপিজি টার্মিনাল। সূত্র জানায়, জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং এর টার্মিনালগুলো নির্মিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছর জাপান সফরে গেলে জাপান সরকার এইসব প্রকল্পে অতিরিক্ত ৩.২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। পাশাপাশি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে একটি প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে এই টার্মিনাল প্রকল্পগুলো জাপানি কোম্পানির বিনিয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। বাংলাদেশ সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতেএই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় জ্বালানি বিভাগের অধীন রাষ্ট্রীয় তেল আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি জাপানি কোম্পানি মিতসুই এর নেতৃত্বে একটি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব পেশ করে। মিতসুই অ্যান্ড কোং লিমিটেড-এর নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম বিল্ড-ওউন-অপারেট (বিওইউ) ভিত্তিতে এই এলপিজি টার্মিনাল গড়ে তুলবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করে। এই কনসোর্টিয়ামে যুক্ত করা হয় এস কে গ্যাস নামে একটি কোরিয়ান কোম্পানীকে, যারা খুব বড় গ্যাস ক্যারিয়ারের মালিক (ভিএলজিসি)। সেই সাথে স্থানীয় পার্টনার হিসাবে যুক্ত হয় এই অঞ্চলের বৃহত্তম এলপিজি অপারেটর ইস্ট কোস্ট গ্রুপকে, যাদের বাংলাদেশে এলপিজি সহ ডাউন স্ট্রিম পেট্রোলিয়াম খাতে প্রায় ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সরকারী সূত্রে জানা গেছে, মিতসুই গ্রুপের সাথে প্রায় দেড় বছরের দীর্ঘ আলোচনার পর জ্বালানী বিভাগ যখন একটি সম্ভাব্য চুক্তির জন্য চূড়ান্ত পর্যায় উপনীত হয়, ঠিক তখনই আশ্চর্য্জনক ভাবে দৃশ্যপটে উপস্থিত হয় জাপানের আরেকটি সংস্থা মারুবেণী কর্পোরেশন। তারা ভিটল নামে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক একটি কোম্পানীকে সাথে নিয়ে পাল্টা একটি প্রস্তাব পেশ করে। মারুবেণী বা তার সহযোগী ভিটল আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি সরবরাহ করলেও কখনও এ জাতীয় এলপিজির গভীর সমুদ্র টার্মিনাল নির্মাণ বা পরিচালনা করেনি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এখন উভয় জাপানী সংস্থা এই প্রকল্পটি পাবার জন্য এক চরম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এবং এ জন্য তারা সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের নিজ নিজ পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। তবে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপিসির প্রথমে সম্ভাব্যতা যাচাই করার কাজ হাতে নেওয়া উচিত এবং এর পর একটি সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া বা উদ্যোক্তা নির্বাচন নীতিমালা তৈরি করে এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দেওয়া উচিত। তারা বলেন, বিশদভাবে প্রাক-সম্ভাব্যতা এবং সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা ছাড়া এ জাতীয় বৃহত্তম প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কোনও সুবিবেচনামূলক সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ এটি করা হলে তা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচুর ঝুঁকি ও ও চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। সূত্র জানায়, বিপিসি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাথে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সাথে একাধিক বৈঠকের পর, মিতসুই বিপিসির কাছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য একটি প্রস্তাব জমা দেয়, যেখানে বিপিসির জন্য ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরো উল্লেখ করা হয়, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ ভবিষ্যত আমদানীকৃত এলপিজি কিনে নিবে এবং এলপিজি টার্মিনাল থেকে অপারেটর টার্মিনালে পণ্য পরিবহনের জন্য ছয়টি নতুন জাহাজ কিনতে অতিরিক্ত ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দিবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জাইকা এধরনের একটি শর্ত যুক্ত করেছে। সূত্র জানায়, অপর জাপানী সংস্থা মারুবেণী কর্পোরেশনও অনুরূপ ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। মারুবেনি ভিটল নামক যে সংস্থাকে অংশীদার হিসেবে সাথে নিয়েছে তারা গত দুই তিন বছর যাবত বাংলাদেশে এলপিজি সরবরাহ করে আসছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন বা এ জাতীয় গভীর সমুদ্র টার্মিনাল নির্মাণ কিংবা পরিচালনার কোনও অভিজ্ঞতা তাদের নেই। এরই মধ্যে অবশ্য ইস্টকোস্ট গ্রুপ অজানা কারণে এ প্রকল্প থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগ এই দুটি প্রস্তাবে কোন মতামত বা সুপারিশ না দিয়েই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয় তাদের সিদ্ধান্তের জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ফাইল ফেরত পাঠিয়ে প্রস্তাব দুটি তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করে তার রিপোর্ট প্রদান করতে বলে। এই প্রকল্পের বিনিয়োগকারী নির্ধারণের জন্য কোন ক্রাইটেরিয়া বা নীতিমালা না থাকায় কর্মকর্তারা এখন প্রস্তাব দু’টির তুলনামূলক মূল্যায়নে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তারা চাইছেন আগে একটি নীতিমালা তৈরি করে তার ভিত্তিতেই বিনিয়োগকারীদের প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করতে।
×