ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষেত্রবিশেষে আমৃত্যু কারাদণ্ড ॥ সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত

যাবজ্জীবন দণ্ড ৩০ বছরের কারাবাস

প্রকাশিত: ২২:৩৬, ২ ডিসেম্বর ২০২০

যাবজ্জীবন দণ্ড ৩০ বছরের কারাবাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যাবজ্জীবনের সাজা ৩০ বছরের কারাবাস। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এ সাজা আমৃত্যু কারাবাস বিবেচিত হতে পারে। আদালত নির্দিষ্ট করে আমৃত্যু কারাদণ্ড বলে দিলে আসামিকে বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাবাস আপীল বিভাগেরই এমন রায় ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ দাবি করে আসামিপক্ষ যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিল, সে আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের ভার্চুয়াল আপীল বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দিয়েছে। আবেদনটি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে জানিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সংক্ষিপ্ত রায়ে বলেন, প্রাথমিক অর্থে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মানে হল, দণ্ডিত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনের বাকি সময় কারাভোগ করবেন। দণ্ডবিধির ৪৫ এবং ৫৩ ধারার সঙ্গে দণ্ডবিধির ৫৫, ৫৭ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(ক) মিলিয়ে পড়লে যাবজ্জীবনের সাজা কমে ৩০ বছর কারাদণ্ডের সমতুল্য হয়। তবে আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল যখন কোন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়, তিনি কার্যবিধির ৩৫(ক) ধারার (রেয়াতি) সুবিধা পাবেন না। রায় ঘোষণার সময় আসামিপক্ষে আদালতে যুক্ত ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। রায় ঘোষণার পর এ্যাটর্নি জেনারেল ও বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরের কারাদণ্ড, তবে আদালত যদি আমৃত্য সাজা দেয়, তাহলে সেটাই গণ্য করতে হবে উল্লেখ করে রিভিউ রায় দিয়েছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ বিভাগ। তবে ৩০ বছরের এ রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় কার্যকর না বলে আদেশ দিয়েছে আপীল বিভাগ। অন্যদিকে রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যাবজ্জীবন কতদিন থাকবে, কতদিন একজন আসামির ভোগ করতে হবে, এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। আমরা সে ব্যাপারে রিভিউ পিটিশন করেছিলাম এবং আমরা বলেছিলাম যাবজ্জীবন বর্তমান আইনের বিধান অনুযায়ী ৩০ বছর হবে। কারণ ৩০ বছর যদি না হয় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(ক)সহ আইনের অন্য বিধানগুলো এবং জেলকোড এগুলো সব বাতিল হয়ে যাবে। ‘আজকের রায়ে আপীল বিভাগ বলেছে, যদিও যাবজ্জীবন বলতে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যতদিন, ততদিন। কিন্তু আইন অনুযায়ী একজন যাবজ্জীবন আসামির ৩০ বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে আইনের অন্যান্য রেয়াদ যেগুলো আছে যদি না আদালত বিশেষভাবে আদেশ দেন আমৃত্যু জেলখানায় থাকতে হবে। আমরা মোটামুটি রায়ে সন্তুষ্ট। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আরও বলেন, আমি এখনও মনে করি, আমৃত্যু সাজার প্রশ্ন যখন আসবে, আদালত থেকে এমন একটা আদেশ আসবে একসময়, যখন প্যারোলের বিধান থাকবে। একটি লোক যখন অথর্ব হয়ে যাবে, বৃদ্ধ হয়ে যাবে, চলাফেরায় অক্ষম হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে বর্তমানে যে বিধান রয়েছে, সরকার তাকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু এ রায়ের পর যখন আমৃত্যু সাজা হবে, সেখানে সরকারের সেই ক্ষমতাও (প্যারোলে মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা) থাকবে না। তাই এটাকে প্রয়োজনবোধে আবার পুনর্বিবেচনার জন্য দ্বিতীয়বার আবেদন করতে পারি। রিভিউ রায়ে আসামি আতাউর মৃধার ক্ষেত্রে কি হবে সেটি উল্লেখ না থাকায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে তা দেখে পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। যাবজ্জীবনের সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড নাকি ৩০ বছর, সে সংক্রান্ত রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৪ নবেম্বর রায়ের জন্য ১ ডিসেম্বর দিন ঠিক করে দেয় আপীল বিভাগ। মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ব্যবসায়ী জামান ইয়াসিনকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। জামানের বাবা সিরাজুল ইসলাম সাভার থানায় পরদিন মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, চারবাগ মাদ্রাসার সামনে জামানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আসামি আনোয়ার, আতাউর মৃধা ও কামরুল তাদের হাতে থাকা আগ্নেয়ান্ত্র দিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করে। এ ঘটনা তদন্ত করে ২০০২ সালের ২৭ জুলাই তিন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। ২০০৩ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক জাহাঙ্গীর আলম মোল্লা তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেন আসামি আতাউর ও আনোয়ার। অন্য আসামি কামরুল পলাতক। একইসঙ্গে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স আকারে হাইকোর্টে আসে। ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি শেষে ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর আপীল খারিজ করে দিয়ে তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেন আতাউর ও আনোয়ার। ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আপীল বিভাগ দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে আদালত যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাবাসসহ সাত দফা অভিমত দেয়। এরপর আসামি আতাউর আপীল বিভাগের অভিমত রিভিউয়ের জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে মঙ্গলবার সংক্ষিপ্ত রায় দেয় আপীল বিভাগ।
×