ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ডক্টর ফস্টাস এবং মেফিস্টোফেলিস

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২ ডিসেম্বর ২০২০

ডক্টর ফস্টাস এবং মেফিস্টোফেলিস

ইংল্যান্ডে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের যে বছর জন্ম সে বছরই ইতালিতে জন্মেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। সাল পনেরো শ’ চৌষট্টি। ইংল্যান্ড তখন প্রটেস্ট্যান্টদের দেশ। ক্যাথলিকদের প্রতি ঘৃণার তীব্রতায় উন্মত্ত হয়ে অনেক ক্যাথলিককে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। সে সময়ের ইংল্যান্ডে রানীর সমালোচনা এবং ঈশ্বর ও খ্রিস্টধর্ম নিয়ে নেতিবাচক প্রচার প্রচারণার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। শেক্সপিয়ার নামের যে বিশ্বখ্যাত অনন্য প্রতিভাধর কবি নাট্যকার অভিনেতাকে আমরা চিনি তাঁর রহস্যময় জীবন নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত থাকলেও ধর্ম ও ধর্ম রক্ষকদের সঙ্গে সংঘাতের কোন কাহিনী নেই। তবে তাঁর সময়ের আরেক নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো খ্রিস্টধর্ম রক্ষকদের রোষে পড়ে প্রাণটাই হারাতে বসেছিলেন। শেক্সপিয়ারের ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্টরা খ্রিস্টধর্মের পান থেকে চুন খসা নিয়ে যখন অতিমাত্রায় সচেতন তখন ইতালির গ্যালিলিও গ্যালিলি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে এ তত্ত্বের পক্ষে হাতেনাতে প্রমাণ উপস্থাপন করে সমাজ-ধর্মের রক্ষকদের তোপের মুখে পড়েছেন। সৌরজগতের বাস্তব রূপ দেখার যন্ত্র টেলিস্কোপ তাঁর হাতে। এ বাস্তবতা মানার মতো শক্তি সাহস বা নৈতিক জোর কোনটাই না থাকায় ধর্ম ও সংস্কারের অন্ধ রক্ষকরা উল্টো গ্যালিলিওকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে যে বিপ্লব তিনি সম্পন্ন করেছেন তার পথরোধ করা অন্ধ সংস্কারের পক্ষে অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে বিজ্ঞান। জয়ী হয়েছেন গ্যালিলিও। যদিও তাঁর সময় পর্যন্ত ইতালিতে বিজ্ঞান ধর্মের কর্তৃত্বের মধ্যেই থেকেছে। তবে বিজ্ঞানের জগতে যে আবিষ্কার তিনি করেছিলেন তা ধর্ম আর বিজ্ঞানের আলাদা পথ তৈরি করে দিয়েছে। তাঁর সমসাময়িক দার্শনিক টমাস হব্্স বিজ্ঞানের মতো দর্শনকেও ধর্মতত্ত্ব থেকে আলাদা করে দেখার কথা বলেছেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল- বিজ্ঞান ঈশ্বরের সৃষ্টি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু আবিষ্কার করবে এবং তাতে ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বাড়বে। আশঙ্কা করেছেন, ধর্ম হয়ে উঠতে পারে মানব সম্প্রদায়ের বিরোধের উৎস। টমাস হব্্স দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম নিয়ে যা বলেছেন তার দার্শনিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। তবে আজকের দিনে বিশেষ করে এ মুহূর্তে নানাভাবে ধর্মের সরব উপস্থিতির দিকে তাকালে হঠাৎ মনে হতে পারে দুর্দান্ত এক ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন তিনি। আসলেই কি তাই? ‘ধর্ম’ বলতে তিনি কি রাজনীতির মোক্ষম অস্ত্রটির কথা বুঝিয়েছেন? সম্ভবত না। সেই নবম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ইমাম ফারাবী, ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালী, ইবনে রুশদসহ অনেক দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ধর্মের অস্ত্রে যেভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন আজকের অস্ত্র ঠিক সেরকম নয়। সেকালে অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে আসার পথ রোধের কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে ঈশ্বর বিশ্বাসীর ‘ধর্ম’। কিন্তু অন্ধকার কেটে আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া যুগে পৌঁছেও ধর্মকে বার বার অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। এবং তার প্রয়োগ অনেক বেশি শাণিত ও কৌশলী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে কারখানায় এর নবায়ন হয় তার নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধে তার ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী সবাই বিপর্যপ্ত-বিধ্বস্ত। সবাই তার কাছে নতজানু। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গনগনে সূর্য অস্তমিত। পুঁজিবাদী কেন্দ্রের ভর তখন আটলান্টিকের ওপাড়ের উত্তর আমেরিকায়। শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন পর্ব। নতুন সাম্রাজ্যে সূর্যোদয়ের সেলিব্রেশন হয় পারমাণবিক বোমায় লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে। পৃথিবী বশের নতুন সব ফর্মুলা আসতে থাকে। একদিকে চীন কোরিয়া ভিয়েতনামসহ বিপ্লবী আবহের পূর্ব এশিয়া, অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামোর দেশগুলোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ নামে যে ফর্মুলা ঘোষিত হয় তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল নতুন বিশ্ব নিয়ন্তাদের হাত শক্তিশালী করতে দক্ষিণপন্থী ইসলামী শক্তিকে শাণিত করা। সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রগুলোকে গড়ে তোলা। এজন্য অর্থ ও অস্ত্রের যোগান এসেছে জোয়ারের মতো। দীর্ঘমেয়াদী সেই পরিকল্পনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফল ইসলামের নামে এক বিকৃত দানবীয় শক্তির উত্থান। ভাবলে বিস্ময় জাগে, কত সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিল আধিপত্য বিস্তারকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের! কোথায় কোন সালে কাদের স্বার্থে ‘ট্রুম্যান ডকট্রিন’ ঘোষণা করেছিল কারা আর বছরের পর বছর ধরে তার বলি হচ্ছে কারা। দক্ষিণপন্থী ইসলামী শক্তিকে শাণিত করার যে টোপ ফেলা হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই তার বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় ধ্বংস হয়েছে দেশ-বিদেশের তরুণ সমাজের এক বড় অংশ। অস্ত্র আর জেহাদী আদর্শে নিজেকে শক্তির শিখরস্পর্শী মনে করে দুনিয়া তছনছ করার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় তারা। তারপর শক্তির বেলুন ফুটো হয়ে এক সময় চুপসে গিয়ে ধুলায় গড়ায়। প্রশ্ন জাগে, তারা কি বুঝতে পারে তাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কোন কেন্দ্রের কোন সুইচ বোর্ড থেকে? হয়ত পারে না। অথবা যখন পারে তখন আর ফেরার পথ থাকে না। হয়ত জেনে বুঝে ক্ষমতার দর্প আর তথাকথিত আদর্শের মোহে স্বেচ্ছায় ছোটে অনেকে। গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ কিংবা ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘ডক্টর ফস্টাস’-এর মতো। ডক্টর ফস্টাসের কাহিনীটি পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করে এ লেখা শেষ করব। ধর্মতত্ত্বের মেধাবী ছাত্র ডক্টর ফস্টাসের মনে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে এক সময় সংশয় জাগে। সংশয়ের ছিদ্র দিয়ে শয়তান মেফিস্টোফেলিস উপস্থিত হয় তার সামনে। তাকে অসীম ক্ষমতার লোভ দেখায়। মেফিস্টোফেলিসের সঙ্গে সে একটি চুক্তিতে যায়। চুক্তির শর্ত হলো : মেফিস্টোফেলিস তাঁকে জাগতিক সব কাজ করার অপরিসীম ক্ষমতা দেবে, তার বদলে পঁচিশ বছর পর ফস্টাসের শরীর থেকে আত্মা কেড়ে নেবে। ফস্টাস রাজি হয়। মেফিস্টোর কাছে আত্মা বন্ধক রেখে ক্ষমতার স্বাদ মেটায় সে। অসম্ভবকে সম্ভব করে দুরারোগ্যকে সুস্থ করে। রাজা রাজড়াদের মনের গোপন ইচ্ছাটি পূরণ করে দেয়। তাকে অসম্মান করলে জাদুবলে ফস্টাস তাদের মাথায় শিং গজিয়ে দেয়। পোপের প্রাসাদে ঢুকে তাকে নাজেহাল করে। কনস্টান্টিনোপলের সুলতানের অন্দরমহলে ঢুকে বেগমদের লাঞ্ছিত করে। এক সময় পঁচিশ বছরের মেয়াদ শেষ হলে মেফিস্টোফেলিসের আসার সময় হয়। ফস্টাস বন্ধুবান্ধব নিয়ে এক সরাইখানায় যায়। সেখানে সবচেয়ে দামী খাবার এবং পানীয় দিয়ে বন্ধুদের আপ্যায়ন করার ফাঁকে ফাঁকে সে তাঁর জীবনের সব ঘটনা বর্ণনা করে এবং জানায়, আজই তার জীবনের শেষ রাত। চুক্তির শর্তানুযায়ী মেফিস্টোফেলিস আজ রাতে তাঁর দেহ থেকে আত্মা কেড়ে নেবে। সে তাঁর পাপের প্রতিফল পেতে যাচ্ছে। বন্ধুদের সে বলে, রাতে বিকট শব্দ হলে কিংবা দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠলে অথবা বজ্রপাতের শব্দ হলে তারা যেন ভয় না পায়। মাঝরাতে সত্যিই এ ঘটনাগুলো ঘটে। বিকট শব্দে সরাইখানা কেঁপে ওঠে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। বজ্রপাত হয়। তারপর সব কিছু শান্ত হলে বন্ধুরা ফস্টাসের রুমে এসে দেখে তার পুরো শরীর থেঁতলে গেছে। মাংসপিণ্ডগুলো এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফস্টাসের আত্মা নিয়ে চলে গেছে মেফিস্টোফেলিস। ধর্মের নামে পথভ্রষ্টদের বেশির ভাগই হয়ত জানে না কোন মেফিস্টোফেলিস শক্তি ও উন্মত্ততার শীর্ষে নিচ্ছে তাদের। মেয়াদ শেষে কেইবা ছুড়ে ফেলছে...।
×