ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পের বহুমাত্রিকতায় উজ্জ্বল নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী শুরু

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১ ডিসেম্বর ২০২০

শিল্পের বহুমাত্রিকতায় উজ্জ্বল নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাদার মাঝে কালো রংয়ে লেপ্্টে দেয়া চৌকোনো বোর্ড। তাতে দৃশ্যমান বিশাল অট্টালিকা, সড়কজুড়ে বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে আছে অজস্র যান-এসব দেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুই শিশু। পুরো দৃশ্যটির ওপর বিঁধে আছে অজস্র পেরেক। চিত্রপটের বিপরীত পাশ থেকে শোনা যাচ্ছে ঠক ঠক শব্দ। নগরজীবনের যন্ত্রণা মেলে ধরা কুন্তল বাড়ৈ সৃজিত স্থাপনাশিল্পটির শিরোনাম ‘দর্শন শব্দ’। প্রকৃতির ওপর মানুষের আগ্রাসনের ছবি এঁকেছেন মোঃ তরিকুল ইসলাম। প্রকৃতি রক্ষার আহ্বানে সাজিয়েছেন চিত্রপট। রং আর রেখার আঁচড়ে পশু-পাখি, বৃক্ষ-লতার সঙ্গে মেলে ধরেছেন মানুষের সহাবস্থান। চিত্রকর্মটির শিরোনাম রিভেঞ্জ-২। ক্ষত নামে রুবাইয়া সাওম দীনার স্থাপনাশিল্পে উঠে এসেছে একাত্তরে নারী নিপীড়নের বীভৎসতা। প্রকৃতির ওপর মানুষের আগ্রাসনের বার্তাবহ ছবি এঁকেছেন মোঃ তরিকুল ইসলাম। রিভেঞ্জ-২ নামের চিত্রকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন সভ্যতা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা। সাবিন ইয়াসমিনের আলোকচিত্রে উঠে এসেছে যত্রতত্র মাস্ক ফেলে জীবাণু ছড়িয়ে দেয়ার শঙ্কা। সমাজ, সভ্যতার নানা সঙ্কট ও সম্ভাবনায় চিত্র মেলে এমন বহুমাত্রিক মাধ্যমের শিল্পকর্মে সজ্জিত হয়েছে নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীর ২২তম আসর। সোমবার থেকে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার পাঁচটি গ্যালারিতে শুরু হলো শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী এই প্রদর্শনী। বিচিত্র আঙ্গিক ও শিল্পরসম্ভারে সজ্জিত হয়েছে এই প্রদর্শনী। আছে চিত্রকলা থেকে ভাস্কর্য, আলোকচিত্র থেকে স্থাপনাশিল্প, কারুশিল্প থেকে মৃৎশিল্প, পারফরমেন্স আর্ট থেকে গ্রাফিক ডিজাইন। তারুণ্যের জয়গান গাওয়া এমন বহুমাত্রিক শিল্পের সম্মিলনে সেজেছে শিল্পায়োজনটি। তারুণ্যের মেধায় সৃজিত শিল্পকর্মগুলোয় দেখা মেলে নিরীক্ষার ছাপ। নতুনত্বকে আবাহনের আহ্বান। নানা মাধ্যমের কাজে উঠে এসেছে জীবন বাস্তবতা থেকে কল্পনার ভুবন। উদ্ভাসিত হয়েছে নগর জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে লোকজ বাংলার প্রতিচ্ছবি। ঠাঁই পেয়েছে সারাদেশের ৩৩৭ তরুণ শিল্পীর ৩৬৮টি শিল্পকর্ম। হেমন্তের বিকেলে একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মান্নান ইলিয়াস, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শহীদ কবির ও একাডেমির সচিব মোঃ নওসাদ হোসেন। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন একাডেমির চারুকলা বিভাগের পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিম। উদ্বোধনী পর্ব শেষে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীদের হাতে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও অর্থের চেক তুলে দেয়া হয়। প্রধান অতিথি বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিশ্বের বহু মুসলিম দেশে অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অথচ মূর্তি আর ভাস্কর্য এক নয়- এটা জেনেও তারা না জানার ভান করছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে মৌলবাদী দলগুলোকে উস্কানি দিচ্ছে, দেশের শান্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে। তাদের সম্পর্কে সরকার সজাগ রয়েছে। সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা ভাবার কারণ নেই। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই দলগুলোর রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড সরকার বরদাশত করবে না। যারা আজ ইসলামের কথা বলছেন, বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অনেক কাজ করে গেছেন। তার কন্যা শেখ হাসিনাও একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তার হাত দিয়েও ইসলামবিরোধী কোন কাজ হওয়ার সুযোগ নেই। কে এম খালিদ বলেন, এ ধরনের প্রদর্শনী তরুণদের সৃজনশীলতা প্রকাশে সুযোগ সৃষ্টি করবে। এদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে শিল্পীরা তাদের রংতুলির মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে হেফাজতে ইসলাম রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। প্রকৃত অর্থে, এই হেফাজতে ইসলাম স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত শিবিরের নেপথ্যের শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এবার প্রদর্শনীতে সব মিলিয়ে এগারোটি মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের পুরস্কার দেয়া হয়। এর মধ্যে সবগুলো মাধ্যম থেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে নবীন শিল্পী চারুকলা পুরস্কার ২০২০ পেয়েছেন সোমা সুরভী জান্নাতের ‘আদিকথা’ শিরোনামের চিত্রকর্মটি। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে চিত্রকলা বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন মোঃ তরিকুল ইসলাম, ছাপচিত্রে মোঃ রফিকুল ইসলাম, ভাস্কর্যে মোঃ মোজাহিদুল রহমান সরকার, প্রাচ্যকলায় সঞ্চয় কুমার প্রামাণিক, কারুশিল্পে রুবাইত-ই-শারমিন, মৃৎশিল্পে তানভীর হোসেন রিদম, গ্রাফিক ডিজাইনে ইমরান হাসান, আলোকচিত্রে মহসিন কবির, স্থাপনাশিল্পে কুন্তল বাড়ৈ, পারফর্মেন্স আর্টে নাঈম হোসেন ও নিউ মিডিয়ায় মোঃ ফজলুল হক। শ্রেষ্ঠ পুরস্কারজয়ী শিল্পীকে প্রদান করা হয় এক লাখ টাকার সম্মানী। এছাড়া এগারোটি শাখার বিজয়ী শিল্পীদের দেয়া হয় ৫০ হাজার টাকার সম্মানী। সঙ্গে ছিল স্মারক ও সনদপত্র। এ বছরের প্রদর্শনীতে প্রথমবার সংযুক্ত হয়েছে আলোকচিত্র। এছাড়া নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীর আরেক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বিশেষ কিউরেটেড প্রদর্শনী। এতে অংশ নিচ্ছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চারুশিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে এই কিউরেটেড প্রদর্শনীতে। চিত্রশালার তিন নং গ্যালারিতে অনুষ্ঠিতব্য এই প্রদর্শনীর ভাবনা ও পরিকল্পনা করেছেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। ৩০ নবেম্বর সূচনা হওয়া নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী চলবে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল এগারোটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রদর্শনী।
×