ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নেটং পাহাড়ে ৮০ বছরের বাঙ্কার- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ৩০ নভেম্বর ২০২০

নেটং পাহাড়ে ৮০ বছরের বাঙ্কার- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক

এইচএম এরশাদ ॥ প্রায় শত বছর আগে দেশের সর্ব দক্ষিণে শেষ সীমানার নাম ছিল নেটং। কালের পরিবর্তনে বর্তমান নাম টেকনাফ। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে যেমন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা চেনেন, তেমনি সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং টেকনাফকেও চেনে না অনেকে। জানা যায়, নেটং পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি প্রবেশমুখ বিশিষ্ট একটি বাঙ্কার রয়েছে। প্রায় ৮০ বছর ধরে ওই বাঙ্কার তিনটি পাহাড়ের সম্মুখভাগে এখনও অক্ষত অবস্থায় শোভা পাচ্ছে। বাঙ্কারটি কখন তৈরি হয়েছিল তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। অনেকে বলছেন, ১৯৪০-৪৫ সালে জাপান সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সেনারা তখন পাহাড় কেটে অদ্ভুত বাঙ্কারটি নির্মাণ করেছিল বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এই অদ্ভুত বাঙ্কারটি পরিদর্শন করতে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা কমান্ডার এই বাঙ্কারের দুটি কক্ষে রাত যাপন করতেন। নাইট্যং পাহাড়ের চূড়া থেকে এক একটি কামানের গোলা ৫০-৬০ মাইল দূরে মিয়ানমারের কোলাডাং গিয়ে পড়ত। তখন বিকট শব্দে কেঁপে উঠত নেটং তথা টেকনাফ অঞ্চল। রবার্ট হার্স নামে ব্রিটিশ সেনা কমান্ডার যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ সময় টেকনাফ আসার জন্য সরাসরি কোন ধরনের যানবাহন ছিল না। কক্সবাজার থেকে বাসে করে উখিয়ার বালুখালী পর্যন্ত, তারপর বালুখালী থেকে জাহাজ বা সাম্পানে করে নাফনদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফ আসা যাওয়া করতেন স্থানীয়রা। স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অর্থাৎ ১৯৪১ সালে মগরা (রাখাইন) মংডুতে মুসলমান নিধন শুরু করে। এর রেশ ধরে টেকনাফেও দুই সম্প্রদায়ে মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কয়েক হাজার মগ সঙ্গে নিয়ে জাপান সেনারা নাফনদী অতিক্রম করে টেকনাফে ব্রিটিশ সেনাদের হটিয়ে দেয়। কিছুদিন পর কলকাতা থেকে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ সেনা এসে জাপান সেনাদের হটিয়ে টেকনাফ পুনরুদ্ধার করে। এই দখল-বেদখল ঘটনায় এবং মগ-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষের রক্তে নাফনদী রঞ্জিত হয়েছিল। এরপর টেকনাফে মগ-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্রিটিশরা ১৯৪২ সালে মগ জমিদার ক্যজাফ্র্রুু চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে টেকনাফ পিস কমিটি (শান্তি কমিটি) গঠন করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সাবরাং এলাকার এজাহার আহমদ কেরানী দারুগা, জালিয়া পাড়ার আবদুল শুক্কুর বলিকে সুবেদার ও ছেবর বলিকে হাবিলদার নিয়োগ করা হয়। থানায় মোট নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ করা হয় ৪৫ জন। তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসক আজগর আলী শাহ, বিচারক (এসডিও) সলিমুল্লাহ খাঁন এবং এসকে দেওলভি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ এবং মগ-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে টেকনাফ এসে কয়েক দফা সভা-সমাবেশ করেন। ১৯৪২ সালে মার্চ মাসে মহকুমা প্রশাসক আজগর আলীর নেতৃত্বে ৫০ জন ব্রিটিশ সেনা দাঙ্গায় মগদের উস্কানির অভিযোগে পিস কমিটির চেয়ারম্যান ক্যজাফ্রু চৌধুরীকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে যান এবং এক মাসের কারাদণ্ড দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে টেকনাফ পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। টেকনাফের নাইট্যং পাহাড়ের চূড়া বা আশপাশে এখনও তাজা গ্রেনেড বা মর্টারশেল পাওয়া যাচ্ছে, অনেকের মতে এসব ব্রিটিশ সেনাদের ওই সময় ফেলে যাওয়া অস্ত্রভাণ্ডারের অংশ বিশেষ মাত্র। ওই নেটং পাহাড়ে অনুসন্ধান চালালে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র গ্রেনেড মর্টারশেলসহ ল্যান্ড মাইন পাওয়া যেতে পারে। দীর্ঘ কয়েক যুগ আগের পরিত্যক্ত এই ব্রিটিশ বাঙ্কারটি ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে আবিষ্কার করে পর্যটকদের দেখার সুযোগ করে দেন টেকনাফ উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুহসিন চৌধুরী। সচেতনমহল বলেন, বাঙ্কারটি পরিদর্শনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টেকনাফের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি, দেখা যাক, ভবিষ্যতে খোঁজ নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।
×