ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৌলবাদের উত্থানের সঙ্গে জঙ্গী গোষ্ঠীও মাথা চাড়া দিচ্ছে

প্রকাশিত: ২১:২৩, ৩০ নভেম্বর ২০২০

মৌলবাদের উত্থানের সঙ্গে জঙ্গী গোষ্ঠীও মাথা চাড়া দিচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশে নতুন করে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ও জঙ্গী গোষ্ঠীর তৎপরতার ব্যাপারে সতর্ক করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সম্প্রতি এক রিপোর্টে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ধর্মান্ধ মৌলবাদের উত্থান ঘটানোর সঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে জঙ্গী গোষ্ঠী। নতুন করে জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে এই শক্তি। উগ্র ধর্মান্ধ ইসলামপন্থী দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে চেষ্টা করেছে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আসার। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এমন একটি সময় রিপোর্টটি বাংলাদেশের হাতে এসেছে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধিতা করছে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি। পরিকল্পিত ভাবেই এদের মাঠে নামানো হয়েছে। তারা এই ভাস্কর্যকে মূর্তি নামে আখ্যায়িত করে এটি অপসারণের দাবি জানিয়ে মাঠ গরম করার জন্য উস্কানিমূলক বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছে। এ নিয়ে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করছে এবং বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কর্মসূচীও ঘোষণা করছে। গত শুক্রবার, ২৭ নবেম্বর দুপুরে জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট থেকে ভাস্কর্যবিরোধী মিছিল বের করে হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন অনুসারী। এতে পুলিশ বাধা দিলে সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে কাকরাইলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় মিছিলে হেফাজত অনুসারীরা ভাস্কর্যবিরোধী বিভিন্ন স্লোগানের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী স্লোগানও দিতে থাকে। তবে তারা কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। সেই সঙ্গে মিছিলে ছিল না কোন ব্যানার কিংবা পোস্টার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে যে, বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদী এবং জঙ্গী সংগঠনগুলোর নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। বরং বিক্ষিপ্ত কোণঠাসা অবস্থায় থাকা এই সংগঠনগুলো আবার নতুন করে সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী সংগঠনগুলো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারির কারণে এদের পরিকল্পনাগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তারপরও সারাদেশে নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বলে মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই জঙ্গী সংগঠনগুলোকে পুনর্জীবিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনৈতিক সংগঠন ভূমিকা রাখছে বলেও গোয়েন্দা মনে করছে। গোয়েন্দাদের এই মতামতের সঙ্গে একমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। তারা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনগুলো এখন মূল ধারার রাজনীতির আশ্রয় -প্রশ্রয় পাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সম্পর্কে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে নানা কারণে মৌলবাদের উত্থান ঘটছে। মৌলবাদী সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে এবং গোপনে নতুন করে তৎপরতা চালাচ্ছে। আর ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করার কারণে এই মৌলবাদীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র এবং টাকা-পয়সাও আসছে। যার ফলে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের রোল মডেল এই বাংলাদেশ নতুন করে সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের উত্থানের শঙ্কা করছে। তারা মনে করছে যে, বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গী গোষ্ঠীকে তাদের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। আবার জঙ্গী সংগঠনের বাইরেও প্রকাশ্যে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশ ক্রমশ দৃশ্যমান মনে হচ্ছে এবং তাদের আস্ফালন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ফ্রান্সের ঘটনাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বড় ধরনের শোডাউন করেছে। বাংলাদেশে আগে মৌলবাদী ধর্মান্ধ দল বলতে জামায়াত ইসলামকে মনে করা হতো। কিন্তু এখন জামায়াত ইসলামের বাইরেও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন এবং হেফাজতে ইসলামের মতো রাজনৈতিক দলগুলো দাপট দেখাচ্ছে। তাদের কর্মী সংগ্রহের হার অনেক বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদন বলছে যে, অতীতে এই জঙ্গী সংগঠনগুলো, ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু এখন তারা মত ও পথের ব্যবধান কমিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে আসতে চাইছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি এই মৌলবাদের উত্থানের একটা বড় কারণ মনে করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। বাংলাদেশে যে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে, তাদের অধিকাংশই মৌলবাদীর চিন্তাচেতনা এবং ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী। সরকার চেষ্টা করেও তাদের সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে মাদক এবং রাষ্ট্রের একটি বড় রুট তৈরি করেছে বলেও মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এদের মাধ্যমেই জঙ্গী সংগঠনগুলোর কাছে অস্ত্র আসছে। আর মাদকের অর্থ বিক্রি করে তারা সংগঠন গোছানোর চেষ্টায় সক্ষম হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিগুলো বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ আইন জারি করার দাবি করে আসছিল। এই শরিয়াহ আইনের মধ্যে অন্যতম ছিল ব্লাসফেমি আইন। অর্থাৎ যারা ধর্মের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করবে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার যে বিধান সেটি তারা কার্যকর করতে চাচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মসূচী পালনকারী ইসলামী আন্দোলন দল ইসলামী শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের কথাও বলছে। আর এটি তাদের ঐক্যের একটি অভিন্ন প্লাট ফর্ম হিসেবে মনে করছে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দাবি-দাওয়ার সঙ্গে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর দাবির সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্য আছে, যাতে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো গোপনে উগ্র মৌলবাদীদের সঙ্গে জোটবন্ধ হয়ে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষ ভূমিকা পালনে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হেফাজত গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। পাঠ্যপুস্তকে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে ইস্যুগুলো আছে, সেগুলোকে বাদ দেয়ার একটি পরিকল্পিত নীলনক্সা বাস্তবায়ন করেছে হেফাজত। এসব বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারও তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। এখন পাঠ্যপুস্তকগুলো আরও মৌলবাদী কায়দায় ঢেলে সাজানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করছে এই মৌলবাদী গোষ্ঠী। আর এই সমস্ত ইস্যু নিয়েই আবার নতুন করে আন্দোলন এবং সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো। অতীতে আল্লামা শফীর নেতৃত্বে হেফাজতের কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। এখন নতুন নেতৃত্বের একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা সরকারকে ইসলামের নামে চাপে ফেলার কৌশল নিয়ে এগোতে চায়। আর এজন্যই তারা ইস্যুগুলোকে নিয়ে মাঠে নামছে বলে মনে করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, উগ্র মৌলবাদী ইসলামপন্থী দলগুলো ও জঙ্গীবাদী সংগঠন অতীতেও বাংলাদেশে নানা রকম চেষ্টা করেছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এসব অবহিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এসব দমন করার সক্ষমতা আছে। এই জঙ্গী সংগঠনগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা এবং দমন করার সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে যে ইসলাম প্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্পর্শকতার ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে চলেছে। দেশে নতুন করে ধর্মান্ধ মৌলবাদী এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা জোটবদ্ধ হচ্ছে। তারা বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে, হুমকি দিচ্ছে, কর্মসূচী দিচ্ছে এবং সংগঠিত হচ্ছে। সরকারের জন্য নতুন মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই স্বাধীনতাবিরাধী অপশক্তি। বিশেষ করে হেফাজতের সম্মেলনের পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি নতুন করে বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে এগোতে চাচ্ছে।
×