ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারের ট্যুরিস্ট পয়েন্টগুলো টার্গেট

কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা ফের বেপরোয়া

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২৯ নভেম্বর ২০২০

কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা ফের বেপরোয়া

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ পর্যটকদের টার্গেট করে কিশোর গ্যাং অপরাধীচক্র ফের দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এই গ্যাংয়ের মধ্যে রয়েছে কিছু রোহিঙ্গা কিশোর ও বিপথগামী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা যুবক। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পর্যটন শহরে ব্যাপক তৎপর রয়েছে। সৈকতপাড়ে সতর্ক রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশও। তারপরও পর্যটন নগরী কক্সবাজারে কিশোর গ্যাং অপরাধীচক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে। জানা যায়, কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের টার্গেট করে ছিনতাইকারী অপরাধী চক্র কিশোর গ্যাং হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্র ধরে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে। খুব অল্প বয়সী এসব রোহিঙ্গা কিশোর গ্যাং-এর অপরাধ প্রবণতা দেখে হতবাক হয়ে পড়ছে প্রশাসন থেকে শুরু করে এলাকার লোকজন। সচেতন মহলের দাবি, ইয়াবা কারবারে বিপুল টাকা আয়ের সুযোগ দেখে এবং ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা রোধে কড়াকড়ি আরোপ করায় রোহিঙ্গা কিশোর বিপথগামী যুবকরা কক্সবাজার শহরে ঢুকে পড়েছে। কেউ রেস্তরাঁয় চাকরি, কেউ টমটম চালক অথবা কেউ ছিনতাই কাজে জড়িয়ে পড়েছে। পিতা-মাতার অসচেতনতার অভাবে কিশোর বয়সে অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছে আশ্রয় ক্যাম্পের রোহিঙ্গা কিশোররা। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে শহরে বসবাসরত পুরনো রোহিঙ্গারা। এটা ধারাবাহিক থাকলে ভবিষ্যতে সমুহ বিপদ অপেক্ষা করছে বলে উল্লেখ করে সচেতন মহল বলছে, রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিষয়ে এখন থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্যাম্পের বাইরে ধরা পড়লে ফের আশ্রয় ক্যাম্পে না পাঠিয়ে দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা নিয়ন্ত্রণে পাড়া-মহল্লায় ব্যাপক সচেতনা তৈরি করতে হবে। ৬দিন আগে রবিবার রাতে শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় রোহিঙ্গা ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয় আনোয়ার হোসেন নামে এক যুবক। তিনি বগুড়ার আদমদীঘির তবিবুর রহমানের পুত্র। চাকরিসূত্রে পরিবার নিয়ে শহরের বিজিবি ক্যাম্প চৌধুরীপাড়ায় বসবাস করতেন। কক্সবাজারে মেডিপ্লাস নামে একটি টুথপেস্ট কোম্পানিতে বিক্রয়কর্মী (এসআর) হিসেবে চাকরিও করতেন তিনি। এ ঘটনায় স্থানীয়দের দাবি কিছুদিন আগে থেকে শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় ছিনতাইকারীর একটি চক্র থাকত। প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে কিছুদিন ধরে পালিয়ে থেকে সম্প্রতি আবারও তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসী জানান, এই গ্রুপে সবাই কিশোর বয়সের। তাদের মধ্যে কিছু আছে বখাটে আবার কিছু আছে মাদকাসক্ত। কয়েক মুখোশধারী পেশাদার ছিনতাইকারী শহরে ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করে টার্গেট করে তাদের গ্যাংয়ের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছে। আলীর জাহাল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মুবিনুল হক বলেন, বাস টার্মিনাল, সিটি কলেজ, সাহিত্যিকা পল্লী এলাকায় বেশ কয়েক কিশোর অপরাধীর অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে মোঃ শফির ছেলে এহসান, মৃত ছৈয়দ করিমের ছেলে বাবু ও রোহিঙ্গাসহ বেশ কয়েকজন। কয়েক মাসের মধ্যে তারা অন্তত ৩/৪টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। থানায় অভিযোগও রয়েছে এসব ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে। পুলিশ তাদের আটক করলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পাহাড়তলী সমাজ কমিটির নেতা সমাজ সেবক মোহাম্মদ রফিক বলেন, কিশোর বয়সী যে ছেলেটি দামী মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে চলে, তার বাবা ছোট তরকারির দোকান করে অথবা এখনও রাজমিস্ত্রি কাজ করে। তাহলে ছেলে এত টাকা কোথায় পায়? মূলত ইয়াবার আগ্রাসন এখন প্রতিটি ঘরে। তাই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। আর কিশোর বয়সের অপরাধীদের কেউ দমাতে পাওে না। কারণ, অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকে। কাউকে সামাজিকভাবে কিছু বলা হলে সে উল্টো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সমাজপতিদের চাপ দেয়। তাই অপরাধীকে দেখে কেউ কিছু বলে না। এভাবেই সমাজে অধপতন তৈরি হচ্ছে। শহরের ক্রাইমজোন খ্যাত সৈকতপাড়া, লাইট হাউজ, বাস টার্মিনাল এলাকার কয়েক মুরব্বি বলেন, এখানে প্রতিটি এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে কিশোর গ্যাং সদস্য। তারাই ঠিক করে চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে অপহরণ, পতিতা ব্যবসা। আবার তাদের নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় পাতিনেতা। স্থানীয়দের দাবি এমনও দেখা গেছে, পাশের বাড়ির ১২-১৫ বছরের ছেলেটি যখন ইয়াবা ব্যবসা করে বিপুল টাকা আয় করছে, দামী গাড়ি ব্যবহার করছে, পরিবারকে ভাল টাকাপয়সা দিচ্ছে, তখন অনেক অভিভাবক তার ছেলেকে উৎসাহিত করে ইয়াবা ব্যবসা করার জন্য। ফলে সেই ছেলেটি কখনও ভাল পথে আসতে পাওে না। এমনকি অনেক মেয়েও এখন অপরাধী হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, আমি এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে একটা জিনিস দেখেছি, যত ছাত্র এসএসসি পাস করে বের হয় তার অর্ধেকও অনার্স বা ডিগ্রী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। তিনি বলেন, আমি এমন অভিভাবক দেখেছি, তাদের জিজ্ঞেস করলে ছেলে কি করে তারা খুব গর্ব নিয়ে বলে ছেলে ভাল টাকা আয় করে। কি এমন ব্যবসা সেটা জানতে চাইলে বলেন, সেটা সেই ভাল জানে আমি জানি না। তাহলে আমি মনে করি অভিভাবকদের কারণে অল্প বয়সে অনেক ছেলে অপরাধের দিকে পা বাড়ায়। পর্যটন স্পট লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, ডায়াবেটিক পয়েন্ট ও ইনানীতে রোহিঙ্গা কিশোররা পর্যটকদের টার্গেট করে ছিনতাই করে থাকে। পুরনো রোহিঙ্গাদের সন্তানরাও জড়িত বেআইনী এই কাজে। এদিকে শহরের টেকপাড়া, বাহারছড়া, নুনিয়ারছড়া, ফিশারিঘাট, সমিতিপাড়া, পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়াসহ সব জায়গায় ব্যাপক হারে কিশোর অপরাধী বাড়ছে বলে জানান স্থানীয়রা। মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শরীফ বাদশা বলেন, মহেশখালীতে বেশিরভাগ বড় বড় অপরাধে ১২ থেকে ২০ বছরের ছেলেরা জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমি মনে করি, এটা সমাজের অবক্ষয়। আর সরকার থেকে একটা আইন করে দেয়া দরকার যে, কত বছর বয়সের ছেলেরা রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে। একই সঙ্গে কত বছর বয়স হলে সামাজিক বা রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে পারবে। এছাড়া যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়া তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচী নেয়া দরকার। চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের কারণে মানুষ এখন সম্মান নিয়ে রাস্তায় চলতে পারে না। আগে যেখানে চায়ের দোকানে বাপ-চাচারা বসে থাকলে ছোট ছেলেরা আসত না, সেখানে এখন ছোট ছেলেদের সিগারেটের গন্ধে মুরব্বিরা বসে থাকতে পারে না। মূলত মাদকের অবৈধ টাকার কারণে সমাজের এই অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। যার বাপ-দাদা কোনদিন রিক্সায় চড়েনি গ্রামে এখন তার ছেলে নোহা নিয়ে চলাফেরা করে। ফলে মানুষ তার কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ শাহজাহান আলী বলেন, কিশোর গ্যাং বা অল্প বয়সের অপরাধীরা শুধু শহরকেন্দ্রিক নয় পুরো উপজেলা বা গ্রামেগঞ্জের অবস্থা আরও ভয়াবহ। মূলত তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার, মাদকের টাকার ছড়াছড়ি, সঙ্গে কিছু অসৎ গ্রাম পর্যায়ের নেতার কারণে কিশোর অপরাধী বাড়ছে। দ্রুত এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অবস্থা ভয়াবহ হবে। আর এই পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিভাবকরা। তারাই সন্তানদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করায় তারা অপরাধী হয়ে উঠছে।
×