ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়তে পারে

প্রকাশিত: ২২:৩৬, ২৯ নভেম্বর ২০২০

আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়তে পারে

রহিম শেখ ॥ প্রতি বছর শেষ মুহূর্তে আয়কর রিটার্ন দাখিলের হিড়িক পড়ে। কিন্তু এবারের চিত্র ঠিক উল্টো। করোনার কারণে এ বছর প্রত্যাশিত হারে আয়কর রিটার্ন জমা পড়ছে না। এর মধ্যে মহামারীতে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, এখনও বেকার, তাদের দিতে হবে গত অর্থ বছরের আয়কর। অনেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ভাইবোন, মা-বাবাসহ নিকটজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে রিটার্ন জমায় আগের প্রস্তুতি হিসেবে ব্যাংক হিসাবের তথ্যসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহ করার কাজকর্ম করতে পারেননি। যার ফলে নিয়মিত করদাতার বাইরে থাকছেন অনেকেই। এদিকে করোনায় রিটার্ন জমার সংখ্যা কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন এনবিআর কর্মকর্তারা। শেষ মুহূর্তে সময় বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন সংস্থাটির উর্ধতন কর্মকর্তারা। সার্বিক বিষয় জানাতে আজ রবিবার এক সংবাদ সম্মেলন করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জানা গেছে, করের আওতা বাড়াতে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার নিয়ম আগের চেয়ে কঠোর করেছে এনবিআর। কিন্তু করোনা মহামারীতে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, এখনও বেকার। নিয়মানুযায়ী, বর্তমানে আয় না থাকলেও দিতে হবে গত অর্থবছরের আয়কর। তেমনি একজন এনামুল হক কবির। করোনার শুরুতেই একটি আবাসন কোম্পানি থেকে চাকরি হারান। এখনও বেকার। আগে যে বেতন পেতেন তাতে করের আওতায় ছিলেন। এ অবস্থায় তাকে দিতে হবে গত অর্থবছরের আয়কর। জনকণ্ঠকে এনামুল হক বলেন, ‘বহু চেষ্টা করেও একটি চাকরি যোগাড় করতে পারিনি। সঞ্চয়পত্র থেকে যে মুনাফা পাই তা দিয়ে কোনভাবে সংসার চালাই। এই অবস্থায় আয়কর দিব কিভাবে?’ করোনা মহামারীর শুরুতে গত মে মাসে রাজধানীর মিরপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানার সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার পদ থেকে চাকরিচ্যুত হন আলমগীর হোসেন। অনেক চেষ্টায় কোন চাকরি না পেয়ে এক আত্মীয়ের গাড়ির শোরুমে অল্প বেতনের চাকরি নেন। গার্মেন্টস কারখানায় আগে যে বেতন পেতেন তাতে করের আওতায় ছিলেন। কিন্তু এখন যা বেতন পান তাতে সংসার চালানোই কষ্টকর। এ অবস্থায় তাকে দিতে হবে গত অর্থবছরের আয়কর। করোনা মহামারীতে এনামুল হক কিংবা আলমগীর হোসেনের মতো দেশে এমন করাদাতার সংখ্যা বেড়েছে বহুসংখ্যক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশনা অনুযায়ী, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন থাকলে অবশ্যই আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয় করদাতাকে। গত অর্থবছর থেকে সকল টিআইএনধারীকে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। তবে কোন অনিবাসীর দেশে স্থায়ী ভিত্তি না থাকলে এবং জমি বিক্রি ও ক্রেডিট কার্ড নেয়ার জন্য টিআইএন নিলে তাদের রিটার্ন দাখিল করতে হয় না। বাকিদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দিতে না পারলে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে দুই থেকে চার মাস পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নেয়া যায়। এ জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। তখন একজন কর কর্মকর্তা আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী জরিমানা, করের ওপর ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সরল সুদ কিংবা করের টাকার ওপর মাসিক ২ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ আরোপ করতে পারবেন। আবেদন করে সময় পেলেও বিলম্ব সুদ দিতে হবে, জরিমানা দিতে হবে না। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ৪৬ লাখের কিছু বেশি। এদের মধ্যে রিটার্ন জমা দেন মাত্র ২২ লাখ। এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২২ লাখ আয়কর রিটার্নের মধ্যে সবাই কর দেন না। নিয়মিত করদাতার সংখ্যা ১৭ থেকে ১৮ লাখ। এনবিআরের সর্বশেষ হিসেবে এ পর্যন্ত রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ১০ লাখ করদাতা। অর্থাৎ এখনও রিটার্ন জমা দেননি ৮ লাখের মতো আয়করদাতা। অনলাইন এবং মেলা না থাকায় চরম বিরক্ত করদাতারা ॥ গত বছরে আয়কর মেলার প্রথম তিনদিনে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল এনবিআরের রাজস্ব আদায়। একদিনেই প্রায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৪০ জন করসেবা নিয়েছিলেন। আর রিটার্ন জমা দিয়েছিলেন প্রায় ৮৪ হাজার ৫৩৫ করদাতা। এর বিপরীতে আয়কর আদায় হয়েছে ২৬২ কোটি টাকা। নতুন করে একদিনে ৪ হাজার ১১ জন ই-টিআইএন নিয়েছিলেন। তবে এবারের আয়কর রিটার্নের পরিস্থিতি পুরোটাই ভিন্ন। প্রতিটি কর অঞ্চলে অল্প পরিসরে মিনি করমেলার মতো আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এতে সাধারণ করদাতাদের আগ্রহ খুবই কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার একদিকে অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়াকে উৎসাহিত করছে, অন্যদিকে বন্ধ রয়েছে অনলাইনে জমা দেয়া। এছাড়া করোনাকালীন ভিড় এড়াতে বেশি প্রয়োজন ছিল অনলাইন কার্যক্রম যা এখনও সচল করতে পারেনি এনবিআর। বিভিন্ন কর অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, স্বল্প পরিসরে করসেবা দিয়ে আসছে কর অঞ্চলগুলো। অনলাইন এবং মেলা না থাকায় চরম বিরক্ত করদাতারা। নিয়ম অনুযায়ী একজন করদাতাকে প্রতি বছর নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন জমা দিতে হয়। এই লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ধরে নবেম্বর মাসে আয়কর মেলা করে আসছে এনবিআর। এবার করোনার কারণে এই আয়োজন থেকে বিরত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি বছর ৩০ নবেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এবারও এর ব্যতিক্রম করা হয়নি। করোনাকালীন অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে চাইলেও রিটার্ন জমা দিতে পারছেন না। এক পাতার রিটার্ন ফরম চালু করলেও এ নিয়েও করদাতাদের মধ্যে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এনবিআরের ওয়েবসাইটে মিলছে না এই এক পাতার রিটার্ন ফরম। নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন জমা দিতে না পেরে আইনী জটিলতায় পড়েছেন করদাতারা। নির্ধারিত সময়ে রিটার্ন জমা না দিলে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে আয়করদাতাকে। জানতে চাইলে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার রিটার্ন জমার সময় বাড়ানো উচিত। এক মাসের জন্য জরিমানা ও করের টাকার ওপর সুদ মওকুফ করলেও করদাতারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। এ ছাড়া ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের রিটার্ন জমা থেকে খুব বেশি আয়কর পাওয়া যায় না। এ ছাড়া রিটার্ন জমার সময় বাড়ালেও এক-দুই মাস পর সেই কর এনবিআর পাবে। তাই সময় বাড়ালে কিংবা জরিমানা ও সুদ মওকুফ করলে এনবিআরের তেমন একটা ক্ষতি হবে না। কারণ, বেশির ভাগ আয়কর আসে উৎসে কেটে রাখা কর থেকে। সময় বাড়নোর চিন্তাভাবনা করছে এনবিআর ॥ প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ৩০ নবেম্বর রিটার্ন দেয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা। ভারতের করদাতারা এপ্রিল থেকে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব দেন। কিন্তু এবার করোনা মহামারীর কারণে গত অক্টোবর মাসে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস জানিয়ে দিয়েছে, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দেশের করদাতারা রিটার্ন দিতে পারবেন। এর মানে, করোনার কারণে ভারতের করদাতারা এক মাস বাড়তি সময় পেলেন। কিন্তু বাংলাদেশে রিটার্ন জমার সময় বাড়ানোয় আইনী বাধা আছে। কয়েক বছর আগেও প্রতিবার রিটার্ন জমার সময় বাড়ানো হতো। কিন্তু ২০১৬ সালে আয়কর অধ্যাদেশে পরিবর্তন এনে ৩০ নবেম্বর জাতীয় কর দিবসের পর রিটার্ন জমা না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সময় বাড়ানোর পথটি বন্ধ হয়ে যায়। এনবিআর কর্মকর্তারা বলেছেন, গত বাজেটের আগে করোনা মহামারী বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। সেই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এনবিআর চাইলে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের যেকোন জরিমানা ও সুদ মওকুফ করে দিতে পারবে। বাজেট অধিবেশনে এনবিআরের এই ক্ষমতাকে আয়কর অধ্যাদেশের ১৮৪(জি) ধারা হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। তাই এনবিআর এখন চাইলে সময় না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জরিমানা ও সুদ মওকুফ করলেই সময় বৃদ্ধির কাজটি করা যাবে। এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, করোনা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এমন বিকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত রিটার্ন কত পড়েছে, তা দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ দিয়ে সরাসরি সময় বাড়ানো হতে পারে। কিংবা প্রজ্ঞাপন দিয়ে এক-দুই মাসের জন্য জরিমানা ও সুদ মওকুফ করা হতে পারে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী, আয়কর আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবীরা রিটার্ন জমার সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এনবিআরে চিঠি দিয়েছেন। সার্বিক বিষয় জানাতে আজ রবিবার সকাল ১০টায় এক সংবাদ সম্মেলনের করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে বক্তব্য রাখবেন সংস্থার চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুমিন।
×