ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাবুনগরীর বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ২৯ নভেম্বর ২০২০

বাবুনগরীর বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ মওলানা মামুনুল হকের পর হেফাজত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীও হুমকি দিলেন এই বলে যে, যে কোন দল ভাস্কর্য বসালে তা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়া হবে। মূলত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে হেফাজত আমির বাবুনগরী সর্বশেষ ঔদ্ধত্যপূর্ণ এমন বক্তব্য দিলেন, যা সাংবিধানিকভাবে ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যে অনাহূত বিতর্কের সৃষ্টি করছে তার নেপথ্যে ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। শুক্রবার রাতে হাটহাজারী সরকারী পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হেফাজত নেতার এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের পর শনিবার সকালে ওবায়দুল কাদের তার সরকারী বাস ভবনে এক ব্রিফিংয়ে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। উল্লেখ্য, হাটহাজারীতে আল আমিন নামের একটি সংস্থা আয়োজিত তাফসিরুল কোরান মাহফিলের শেষদিনে বিতর্কিত মামুনুল হক বক্তব্য দেয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতার দিনভর প্রতিবাদের মুখে আয়োজক গোষ্ঠী তাকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়নি। তবে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হেফাজত আমির জুনায়েদ বাবুনগরী মওলানা মামুনুল হকের চেয়ে আরও একধাপ বাড়িয়ে যেসব হুমকি দিয়েছেন তা নিয়ে নানা মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শুক্রবার রাতে দেয়া ওই বক্তব্যে বাবুনগরী বলেছেন, মদিনা সনদে দেশ চললে এদেশে কোন ভাস্কর্য থাকতে পারে না। মদিনায় কোন ভাস্কর্য নেই। এদেশেও কোন ভাস্কর্য থাকতে পারে না। শরীয়তে ভাস্কর্যের কোন অনুমতি নেই। তিনি বলেন, কোন দলের নেতা বা ব্যক্তির নয়, তার (বাবুনগরী) পিতার ভাস্কর্য বসালেও সেটা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়া হবে। বাবুনগরী আরও বলেছেন, এদেশ রাশিয়ার সনদে চলবে না। চীনের, ভারতের, আমেরিকার সনদেও চলবে না। দেশে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ চলছে। ইসলামের কথা বলার কারণে অনেকে গ্রেফতার ও নির্যাতিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বাবুনগরী বলেন, আমরা আপনাকে ভালবাসি। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ভালবাসি। আমরা আপনার দুশমন নই। আমাদের দুশমন মনে করবেন না। আপনার পেছনে যে নাস্তিক মুরতাদ ঘাপটি মেরে বসে আছে তারাই আপনার দুশমন। বঙ্গবন্ধুকে কোন আলেম-ওলামা মারেননি। মেরেছে তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজন। আমার আশঙ্কা আপনার পেছনে থাকা নাস্তিক মুরতাদরা আপনার ক্ষতি করবে। মাহফিলে বাবুনগরী কাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘোষণার দাবি জানিয়ে বলেন, এরা নবীর শত্রু, নবীর দুশমন। এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলমান ঘোষণা করতে হবে। কাদিয়ানীরা মুসলমান নয়, তাদের সঙ্গে মুসলমানদের বিয়েশাদি হতে পারে না। তাদেরকে মুসলমানদের কবরে দাফন করাও যাবে না। তাদেরকে মুসলমানদের মতো ভিসা দিয়ে মক্কা- মদিনায় যেতে দেয়া যাবে না। বাবুনগরী বলেন, আমি ৮১ আলেমকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। আমি বলেছি, কাদিয়ানীরা কেবল ইসলামের শত্রু নয়, এদেশের স্বাধীনতারও শত্রু। ইসকনের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়ে বাবুনগরী বলেন, বর্তমানে মুসলমানদের বড় শত্রু ইসকন। এ ইসকনের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বাবুনগরী আরও বলেন, নবীর প্রতি কোন বেয়াদবি, অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় তাহলে এদেশের মুসলমানরা তাদের জিহ্বা কেটে ফেলবে। বাংলাদেশে ফান্সের দূতাবাস বন্ধ করে দিতে হবে এবং সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ফান্স সরকারপ্রধান ম্যাক্রোঁ সকল মুসলমানের কাছে ক্ষমা চাইবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ফান্সের দূতাবাস থাকতে পারবে না। শুক্রবার রাতে বাবুনগরীর এমন বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার সকালে ঢাকায় তার বাস ভবনে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মনে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী এদেশে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা, চর্চা এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারে মাদ্রাসা বোর্ড পুনর্গঠনসহ ইসলাম প্রচারে তবলিগ জামায়াতকে জমি প্রদান করেন। অপরদিকে, শুক্রবার বিকেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, মৌলবাদ সব দেশে সব মানুষের সব ধর্মের জন্য বিপজ্জনক। মৌলবাদী গোষ্ঠী সারাদেশে হুমকি-ধমকি দিয়ে মাঠ গরম করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই মৌলবাদী গোষ্ঠী ধর্মীয় সংগঠন করে রাজনৈতিক খায়েশ মেটাচ্ছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি ও আদর্শে বিশ^াসী সকলেই প্রতিবাদ করলে এরা লেজ গুঁটিয়ে পালিয়ে যাবে। মূলত হাটহাজারীর অনুষ্ঠানটি ছিল পবিত্র তাফসিরুল কোরান মাহফিল। কিন্তু এ মাহফিলে কোরানের তাফসিরের ব্যানারে পবিত্র ইসলামকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে বলে জল্পনাকল্পনা চলছে। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত যখন খোলস পাল্টানোর চেষ্টা করছে তখন জামায়াতীদের অনেকেই হেফাজতের ব্যানারে একত্রিত হচ্ছে। আর হেফাজত এখন বক্তব্য দিচ্ছে জামায়াতী স্টাইলে। একদিকে সরকার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়ে হাজার হাজার কওমি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত জীবন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছে, তখন এ কওমিদের সমর্থিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের এসব নেতা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন তা প্রকারান্তরে জামায়াতের প্রেতাত্মা হিসেবেই আবির্ভূত বলে প্রতিভাত হচ্ছে। সুন্নি মতাদর্শীয় বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ হেফাজত নেতাদের এহেন কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণ অনাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত বলছেন। তারা বলছেন, এর নেপথ্যে গোপন কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। যে ইঙ্গিত ওবায়দুল কাদেরও শনিবার দিয়েছেন। ইসলামীসহ বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেখানে নামীদামী ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে সেখানে বাংলাদেশে ভাস্কর্য স্থাপন তাও আবার জাতির পিতার ভাস্কর্য নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টির নেপথ্যে নিশ্চয় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার অপচেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে। তাদের মতে, এরা ধর্মের নামে ব্যবসা করে, ধর্মপ্রিয় মানুষকে বিভ্রান্ত করে। গত শুক্রবার সারা চট্টগ্রাম মহানগরী ও ঘটনাস্থল হাটহাজারী ছিল একেবারেই উত্তপ্ত। ছাত্র-জনতা ধৈর্যের পরিচয় দেয়ার কারণে অনাকাক্সিক্ষত কোন ঘটনা ঘটেনি। আবার ছাত্র-জনতা হুমকির মুখে হেফাজত নেতা মামুনুলকে তাফসিরুল কোরান মাহফিলের মঞ্চে ওঠার সুযোগ দেয়া হয়নি, বক্তব্য দেয়া তো দূরের কথা। এখানেই হেফাজতীদের ঘটেছে পরাজয়। মূলত এরা শক্তের ভক্ত নরমের যম হিসেবেই চিহ্নিত। হেফাজতীদের ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর পুলিশী অভিযানে পালিয়ে যাওয়ার চিত্র তা-ই প্রমাণ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে জামায়াত-বিএনপি দেশে অপরাজনীতির কোন সুযোগ পাচ্ছে না। আগুন সন্ত্রাসসহ নানা কারণে এরা প্রচণ্ড সমালোচিত। এ সুযোগে হেফাজতীরা জানান দিতে চাচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ডে। হেফাজতীরা মুখে বলে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। অথচ, কথাবার্তা, বক্তব্য এবং সভা-সমাবেশ সবকিছুর নেপথ্যে রাজনীতি হচ্ছে। তবে এ রাজনীতি সম্পূর্ণ অপরাজনীতি। কওমি সমর্থিতরা ছাড়া এদের সঙ্গে অন্যরা নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। সূত্রগুলো বলছে, হেফাজত ক্রমাগতভাবে সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। আবার মাঠে-ময়দানে যেসব তৎপরতা চালাচ্ছে তার সবই সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তাই সময় থাকতে এদের ব্যাপারে সজাগ হওয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় হেফাজতীরা কিছুটা ঢাকঢোল পেটাতে পারে। দেশের অন্য কোথাও তাদের কোন জোর নেই। তবে সরকার বৃহত্তর স্বার্থে এদেরকে সভা-সমাবেশের যে সুযোগ দিচ্ছে তা যদি তারা অপরাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করে তা তাদের জন্যই বিপজ্জনক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সঙ্গত কারণে নিজেদের মঙ্গলের জন্য তাদেরকে সজাগ হতে হবে, জামায়াতীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার রাস্তা পরিহার করতে হবে। এসব নিয়েই হেফাজতীদের ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা চলছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে। তাদের মতে, বাবুনগরীদের ভাবতে হবে তাদের শীর্ষ নেতা মাওলানা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুকালীন এবং তৎপরবর্তী তারা যেসব ঘটনার অবতারণা করেছে তা নিয়ে। যে পথে তারা নেতা নির্বাচিত হয়েছেন সে পথের সঙ্গে মদিনা সনদের কোন সামঞ্জস্য নেই। উল্টো তাদের সকল তৎপরতা মদিনা সনদবিরোধী বলেই আলোচিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই ইসলামের প্রকৃত বাণী নিয়েই তাদের এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অপরাজনীতি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা কখনও সুখকর হতে পারে না।
×