ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক

জীবনের মঞ্চ থেকে আলী যাকেরের চিরবিদায়

প্রকাশিত: ২২:০৩, ২৮ নভেম্বর ২০২০

জীবনের মঞ্চ থেকে আলী যাকেরের চিরবিদায়

মনোয়ার হোসেন ॥ দর্শকের জন্যই বারবার ফিরে আসি এই মঞ্চে। এটা আমার ভালবাসার জায়গা। সবকিছু ভুলতে পারলেও ভুলতে পারি না এই মঞ্চকে। যতবার নাটক নিয়ে মঞ্চে উঠি প্রতিবারই যেন আমার পুনর্জন্ম হয়। একসময় ভেবেছিলাম অনেক বয়স হয়েছে তাই মঞ্চে আর ফিরতে পারব না; এই নিয়ে নিজেরই সন্দেহ ছিল। কিন্তু শুভাকাক্সক্ষীদের ভালবাসায় আবার ফিরে এসেছি এই মঞ্চে ...। এভাবেই মঞ্চনাটকের প্রতি আপন অনুরাগ প্রকাশ করেছিলেন আলী যাকের। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর তিনি সদর্পে বিচরণ করেছিলেন নাট্যমঞ্চে। অভিনয় করেছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আলোচিত নাটক গ্যালিলিওর যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীর চরিত্রে। সেই প্রদর্শনী শেষে দর্শকের করতালির জবাবে বলেছিলেন মনের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো। অনবদ্য অভিনয়শৈলীর আশ্রয়ে এমন করেই তিনি নূরলদীনের সারা জীবন থেকে দেওয়ান গাজীর কিস্্সা নাটকে রূপ দিয়েছেন রকমারি চরিত্রে। ছুঁয়েছেন দর্শক হৃদয়। নাট্যমঞ্চে দর্শকের হৃদয়ছোঁয়া এই বরেণ্য অভিনয়শিল্পী এবার বিদায় নিলেন জীবনের মঞ্চ থেকে। মঞ্চ থেকে টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের এই কুশলী শিল্পী সেই সৃজনশীল জীবনকে সাক্ষী রেখে পাড়ি জমালেন অদেখার ভুবনে। শুক্রবার সেই বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। এদিন সকাল ছয়টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। চার বছর ধরে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইরত অবস্থায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি কোভিড পজিটিভি শনাক্ত হন। দেশের নাট্য আন্দোলনের এই পথিকৃৎ অভিনেতা, নির্দেশক, বাচিকশিল্পী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির কর্ণধারের বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। রেখে গেছেন স্ত্রী অভিনেত্রী সারা যাকের, অভিনেতা ছেলে ইরেশ যাকের ও মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়াসহ অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী, সহযাত্রী ও স্বজনকে। ইরেশ যাকের গণমাধ্যমকে জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত এই অভিনেতা করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সপ্তাহ দুই আগে। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে গত রবিবার ফিরে গিয়েছিলেন বাসায়। এরপর আবার অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার ভোরে সেখানেই তিনি মারা যান। আলী যাকের প্রয়াণের সংবাদে সংস্কৃতি অঙ্গনসহ সাধারণের মাঝে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনে সহযাত্রীরা ছুটে যান আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে। লাল-সবুজের পতাকায় মোড়া শবদেহের প্রতি নিবেদন করেন ফুলেল ভালবাসায় আবৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি। স্মরণ করেন তার কীর্তিময় জীবনের কথা। এদিকে তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্টজনরা। শোক জানানো হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। শুক্রবার সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে বেলা বারোটা সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে আসা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিউগলের করুণ সুরে এই শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় গার্ড অব অব অনার প্রদান করা হয়। এরপর শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির কার্যালয়ে। সেখানে নিবেদন করা হয় দ্বিতীয় দফা শ্রদ্ধাঞ্জলি। এরপর বাদ আসর বনানী করবস্থানের মসজিদে জানাজা শেষে সমাহিত করা হয় স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধ একুশে পদকপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা অভিনয়শিল্পীকে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিশিষ্টজনদের শোক প্রকাশ ॥ এই সংস্কৃতিজনের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুতে দেশ একইসঙ্গে এক বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল। অপর এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আলী যাকেরের অবদান। শোকবার্তায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, অভিনয় ও সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে এদেশের অগণিত দর্শক- শ্রোতার হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন তিনি। এছাড়াও এই নাট্যজনের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, কৃষিমন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোক জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, খুলনায় প্রতিষ্ঠিত ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টসহ বিভিন্ন সংগঠন। সহযাত্রীদের শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ সকাল এগারোটার পর জাতীয় পতাকায় মোড়া আলী যাকেরে কফিনটি নিয়ে আসা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আঙিনায়। এ সময় শিল্পীর শবদেহের পাশে ছিলেন স্ত্রী সারা যাকের, ছেলে ইরেশ, মামুনুর রশীদসহ নাট্যাঙ্গনের বাসিন্দারা। সেখানেই সহযাত্রীর শবদেহে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন নাট্য ভুবনের মানুষেরা। বেদনাবিধুর হৃদয়ে তারা বলেছেন আলী যাকেরের কীর্তির কথা। বলেছেন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকার কথা। শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনে শেষে বেদনার্ত কণ্ঠে সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ও সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমার জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন আলী যাকের। সহযাত্রী হিসেবে একসঙ্গে কেটেছে দীর্ঘ ৫০টি বছর। আমার নাটক, আমার ক্যারিয়ার-এ সবকিছুর নেপথ্যে রয়েছে তার অবদান। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা ছিল পরিবারের চেয়েও বেশি। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, প্রথমে রবিউল হুসাইন, এরপর জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর পর আজ চলে গেলেন ছটলু ভাই। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে কাজ করতে গিয়েই পরিচয় ও প্রণয়ের কথা প্রকাশ করে সারা যাকের বলেন, এক ছাদের নিচে কেটে গেছে ৪৩টি বছর। সেই সুবাদে আলী যাকের ছিলেন আমার দীর্ঘদিনের সহযাত্রী, সহকর্মী ও বন্ধু। বাসা থেকে শেষ যখন তাকে লিফটে করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখনও তিনি খুঁজছিলেন আমাকে। তার অসুস্থতায় অনেকেই তার পাশে থাকলেও আমি বুঝতে পারিনি আমার ওপর তিনি কতটা নির্ভরশীল ছিলেন। এই নির্ভরশীলতা আমাকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেল। কথা প্রসঙ্গে এই অভিনেত্রী বলেন, আলী যাকেরের সর্বশেষ ইচ্ছা ছিল ‘গ্যালালিও’ নাটকে অভিনয় করার। সেটা সম্ভব হয়েছে। তাই তার শেষ ইচ্ছাটি পূরণ হয়েছে। আলী যাকেরের মূল্যায়নে নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, আজকে আমাদের মঞ্চনাটকে একটা বড় স্তম্ভের পতন হলো। তার মতো এত বড়মাপের অভিনেতা আমরা আর পাব না। ‘গ্যালিলিও’ কিংবা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ তাকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আলী যাকেরের সঙ্গে ফেরদৌসী মজমুদারকে নিয়ে ‘প্রেমপত্র’ নামে একটি নাটক করার পরিকল্পনা করেছিলাম। দুই বছর ধরে প্রতীক্ষা করলেও সেটা সম্ভব হলো না। আলী যাকের পরিপূর্ণ জীবন যাপন করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন। নাটকের দলের সংগঠক হিসেবেও চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছিলেন। একইভাবে মামুনুর রশীদ বলেন, দুই বাংলার নাটকের একটি স্তম্ভের মৃত্যু হয়েছে। বাংলা নাটক যারা বুঝতে পারতেন তিনি তাদেরই একজন ছিলেন। বাংলাদেশের নাটকের প্রারম্ভিককালে যে উত্থান হয়েছিল তার পেছনে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে নুরলদীনের সারা জীবন নাটকে তার অভিনয় কালজয়ী হয়ে থাকবে বাংলা মঞ্চনাটকের ইতিহাসে। আলী যাকেরের চলে যাওয়ায় আক্ষেপ করে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, আমরা কি হারিয়েছি তা ধীরে ধীরে টের পাব। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, ছিলেন সহ-অভিনেতা ও সহমর্মী। যে মানুষকে আমরা হারিয়েছি হয়তো সময়ের আবর্তে তাকে ভুলে যাব। কিন্তু রয়েছে তার কাজ কিংবা অভিনয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী বলেন, তার মতো প্রিয়জন সম্পর্কে মূল্যায়ন করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করা এক পরিপূর্ণ মানুষ আলী যাকের। ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করতেন বঙ্গবন্ধুকে। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজ শুরু করি তখন আলী যাকের গঠনমূলক সিদ্ধান্তের কারণে আমরা অনেক বিতর্কের বাইরে থাকতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তার স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন আলী যাকের। তার বেশ কিছু সাধারণ মানুষ জানে। যেটা জানে না, তার একটি হলো তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে ইংরেজিতে ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য দিতেন। নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, বাংলা মঞ্চে আলী যাকেরের চরিত্রের শেষ নেই। ‘গ্যালিলিও’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকে নাম ভূমিকায় তার ধ্রুপদী অভিনয় উদাহরণ হয়ে থাকবে। চরিত্রকে ধারণ করে তিনি উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে তাকে শ্রদ্ধা জানান ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডীন নিসার হোসেন প্রমুখ। এসময় আরও শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, থিয়েটার, স্রোত আবৃত্তি সংসদ প্রভৃতি। শিল্পীর জীবনকথন ॥ আলী যাকেরের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৬ নবেম্বর চট্টগ্রামে। বাবা ছিলেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মোহাম্মদ তাহের ও মা স্ত্রী রিজিয়া তাহের। চট্টগ্রামে জন্ম হলেও আলী যাকেরের পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। বাবা মোহাম্মদ তাহেরের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলী যাকের। ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়া ঘুরে বাবা যখন প্রাদেশিক সরকারের সচিব হলেন, তখন আলী যাকেরের পরিবার থিতু হয় ঢাকায়। সেন্ট গ্রেগরি থেকে মাধ্যমিক এবং নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আলী যাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই জড়িয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়, সেই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে। আলী যাকের তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেলে তিনি মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে করাচীতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডব্লিউ এস ক্রফোর্ডাসে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে আলী যাকেরের কর্মজীবন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন। ছিলেন কোম্পানির গ্রুপ চেয়ারম্যান। এর আগে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী যাকের প্রথমে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ১৯৭২ সালে আলী যাকে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন। যার প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে। ১৯৭২ সালের জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন। ঐ দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে অভিনয় করেন, যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ওয়াপদা মিলনায়তনে। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে; যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। এছাড়াও ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘কোপের্নিকের ক্যাপটেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অনেক আলোচিত মঞ্চনাটকের অভিনেতা ও নির্দেশক তিনি। পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর’, ‘দেয়াল’সহ বহু নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন আলী যাকের। বেতারে ৫০টির বেশি নাটক করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে। এছাড়াও টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছেন, করেছেন শখের ফটোগ্রাফি। লেখালেখিও করেছেন। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি এবং যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য। ছিলেন। অভিনয় ও নির্দেশনার বাইরে আলী যাকের ছিলেন একজন নাট্যসংগঠক। নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া দীর্ঘ কর্মজীবনে অর্জন করেছেন শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা। আলী যাকেরের স্ত্রী সারা যাকেরও মঞ্চ আর টেলিভিশনের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে ইরেশ যাকের ও শ্রিয়া সর্বজয়াও অভিনয়শিল্পী।
×