ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতিমুক্তির মাঙ্গলিক অভিযান

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৮ নভেম্বর ২০২০

দুর্নীতিমুক্তির মাঙ্গলিক অভিযান

কী করুণ আর্তনাদে বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের ‘জন্মান্তর’ কবিতার উচ্চারণ- ‘আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক,/ আমি চাই না হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক।/ আমি নাই-বা গেলাম বিলাত,/ নাই-বা পেলাম রাজার খিলাত-/ যদি পরজন্মে পাই রে হতে ব্রজের রাখাল-বালক/ তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে সুসভ্যতার আলোক ॥’ মানব সভ্যতার মানদণ্ডে মৌলিক নিয়ামক হচ্ছে সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-আনন্দের অনুরঞ্জন পরিচায়ক। আদি থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের প্রজ্বলন ঘটিয়ে অশুভ-অন্ধকার শক্তির নিধনকল্পে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ছিল কল্যাণমুখী অনপেক্ষ মানবিক সমাজ। কালপরিক্রমায় পরিলক্ষিত হচ্ছে একদিকে মানবসৃষ্ট আলোর প্রসারমানতা; অন্যদিকে মানুষরূপী দানবের অরাজক কুপ্রবৃত্তির হিংস্র বহির্প্রকাশ। সামঞ্জস্যহীনতায় অনেকক্ষেত্রে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল মানবধর্মের প্রকৃত অনুষঙ্গ। অসাম্প্রদায়িকতা-মানবিকতা-সৃজনশীলতা-মননশীলতাকে রুদ্ধ করার অপপ্রয়াস শুধু বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেনি; বিশ্বের সকল সভ্য মানুষের মুক্ত চিন্তা-চেতনা-ধারণাকে করেছিল নিদারুণ ক্ষোভিত। সুগভীর অন্ধকার যেমন কখনও আলোর নিগূঢ়তম বিস্তারকে আড়াল করতে পারেনি; তেমনি এগিয়ে যাওয়ার অভিযাত্রায় প্রতিবন্ধকতার কূট নির্মাণ সভ্যতাকেও স্তব্ধ করতে পরিপূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ‘সত্য-সততা-সত্যবাদিতার জয় অনিবার্য’, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’ এসব অমিয় প্রবাদসমূহ সময়ে-অসময়ে নির্দয় অবজ্ঞার শিকারে পরিণত হলেও তার স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ-ইতিহাস এমনই শিক্ষায় উদ্ভাসিত আবর্ত। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের অদম্য অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে সন্ত্রাস-দুর্নীতি-জঙ্গিত্বসহ সকল কুৎসিত দুর্বৃত্তায়নকে বিনাশ করার ব্রত বারংবার জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। দেশপ্রেমিক প্রতিরক্ষা-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রাঞ্জল সমন্বয়ে গঠিত ‘র‌্যাব’ ইতোমধ্যেই তাদের সফল ও সার্থক অভিযানে সরকারের কঠোর নির্দেশনাকে কার্যকর ও দৃশ্যমান করেছেন। চৌকস-দক্ষ-প্রশিক্ষিত-সততার শীর্ষে; নির্ভীক সাহসিকতায় ঘৃণ্য দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে র‌্যাব পরিচালিত দুর্দণ্ড কার্যক্রম সর্বত্রই প্রগাঢ় প্রশংসিত ও সমাদৃত। বস্তু-সত্যনিষ্ঠ-নিরপেক্ষ নিবিড় তদন্ত-পুনর্নিরীক্ষণ-যাচাই-বাছাই পর্যায়ে নিষিক্ত নিশ্চিত হয়ে র‌্যাব কর্তৃক যথাযথ অভিযান পরিচালনার জন্য দেশবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধমূলক কথিত মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের নামে অহেতুক মিডিয়া ট্রায়াল পরিহার করে অপরাধীর অপরাধ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত হয়ে হাতেনাতে এসব পাপিষ্ঠ অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে গণমাধ্যম-দেশবাসীকে উপস্থাপনে সুদূরপ্রসারী ফল প্রত্যাশিত। মিথ্যাচার-পাপাচার-কদাচার-প্রতারণার অপকৌশলে দেশের সম্পদ-ভূমি-বাণিজ্য-অর্থ-উচ্চশিক্ষাসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থা আরোপিত পদ-পদবি-পদক ইত্যাদির দখল-লুণ্ঠনের রমরমা বাণিজ্যিকীকরণ জাতি অতিশয় অসহায়ত্ব ও যন্ত্রণা-কাতরতায় অবলোকন ও নীরবে সহ্য করে আসছে। সাম্প্রতিককালে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীরা করোনার এই দুঃসময়েও অবৈধ অর্থের হীন বিনিয়োগ করে চলছে। দেশব্যাপী তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নৃশংস ও সহিংস ঘটনা তৈরির কুশীলবদের বিষাক্ত নিশ্বাসে সংক্রমিত হচ্ছে পুরো জাতি-রাষ্ট্র। মাদক-অস্ত্রের জঘন্য অপব্যবহার-ক্রয়-বিক্রয়, হত্যা-আত্মহত্যা-কিশোর গ্যাং অপরাধ; কথিত ফেসবুক-সামাজিক যোগাযোগ বা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে পরকীয়া-ব্যভিচার-শিশু ও নারীর প্রতি আদিম পাশবিকতা পুরো সমাজকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। এসব অপকর্ম প্রতিরোধে ইতিবাচক কর্মকৌশল বাস্তবায়নে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভূতপূর্ব প্রচেষ্টায় আপামর জনগণ আশ্বস্ত হলেও বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ্য কুকর্ম এখনও অব্যাহত রাখার প্রয়াস প্রকাশ পাচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহতার বার্তা দেশবাসীকে অজানা আশঙ্কা-আতঙ্কে যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে তুলছে। অতিসম্প্রতি বিশ্বে একদিনেই এগারো হাজার প্রাণসংহারের ঘটনা বিশ্ববাসীকে অপরিমেয় ভীতসন্ত্রস্ত করছে। শুধু ইউরোপে প্রতি সেকেন্ডে সতেরো জন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মিনিটে একজনের প্রাণনিধনের নির্মম বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র-উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সমগ্র নাগরিকের হৃদয়ে উৎকণ্ঠার বিস্তৃতি ঘটছে। গণমাধ্যম সূত্রে অর্থনৈতিক সম্ভাব্য সঙ্কটের প্রতিফলনে জানা যায় যে; গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যের আলোকে ২০২০ সালে বিশ্বের দেশসমূহের পিপিপি/জিডিপি অনুসারে আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করেছে। ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯শ’ মার্কিন ডলারে পিপিপি/জিডিপি মূল্যায়নে কাতারের অবস্থান বিশ্বশীর্ষে রয়েছে। ১৯১টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ হাজার ২৮ মার্কিন ডলার হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৩তম, ৮ হাজার ৩শ’ ৭৮ মার্কিন ডলারে ভারতের অবস্থান ১২৪তম এবং ৫ হাজার ৮শ’ ৭২ মার্কিন ডলারে পাকিস্তান ১৩৮তম অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সকল বিপরীত-বিপদগ্রস্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে করোনা প্রতিরোধে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘোষণা পুরো দেশকে নিরন্তর আশ্বস্ত করছে। বিগত বছর থেকে শুরু করে ক্যাসিনো-মাদক-অস্ত্র-দুর্নীতি-অসামাজিক কার্যক্রমে অবৈধ আধিপত্য-ক্ষমতার যথেচ্ছাচার-ভূমি ও জলদস্যু-টেন্ডার বাণিজ্যসহ সকল অপকর্মে জড়িত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাজার হাজার কোটি টাকার অনৈতিক উপার্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা দেশবাসীসহ সমগ্র বিশ্ব অবহিত হয়েছে। এইক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থান ও জিরো টলারেন্স পদক্ষেপে অতিশয় অনুপ্রেরণা ও প্রেষণার ক্ষেত্র নির্মিত হয়েছে। অধিকাংশ এসব ঘৃণ্য ব্যক্তিদের কোন ধরনের সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয়কে ন্যূনতম আমলে না নিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে এসে যোগ্যতম গণতান্ত্রিক সরকার যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। করোনার দুঃসময়েও এসব দুর্বৃত্তদের মাস্ক, স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামাদি, করোনা প্রতিরোধে বিভিন্ন কিট বা ওষুধপত্র ইত্যাদি সরবরাহে কদর্য দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ উচ্চতর প্রশংসার দাবি রাখে। এতকিছু ইতিবাচক কর্ম-সন্তুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই, আন্তর্জাতিক ঘুষবিরোধী সংস্থা ‘ট্রেস ইন্টারন্যাশনাল-এর মতে বাংলাদেশ ঘুষের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই জরিপ অনুসারে বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৬। সরকারী খাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘুষের চিত্রে ১শ’র মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৬৬, ডেনমার্কের মাত্র ১ দশমিক শূন্য এবং উত্তর কোরিয়ার ৯৮ স্কোরের স্থিতি সকলকে অত্যধিক হতাশাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়ার গন্তব্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই এসব দুর্বৃত্তায়নের পরিসংখ্যান অতীব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এনে অনতিবিলম্বে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু কানাডায় ‘বেগমপাড়া’খ্যাত অভিজাত এলাকায় ২৮ জন সরকারী কর্মকর্তার অবৈধ অর্থ উপার্জন ও পাচার এবং বিলাসবহুল অট্টালিকা নির্মাণ-বাণিজ্য পরিচালনা বিষয়ে দ্রুততর সময়ের মধ্যে মহামান্য আদালতকে অবহিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করি; র‌্যাবসহ দেশপ্রেমিক সংস্থাসমূহ অচিরেই এ সমস্ত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে পিছপা হবে না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে, সামগ্রিক অর্থে দেশ পুনর্গঠনের প্রাক্কালে নানাবিধ নৈরাজ্য-সন্ত্রাস-দুর্বৃত্তায়নের নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনে দেশে অনাকাক্সিক্ষত-অনভিপ্রেত রাজনৈতিক পরিবেশ ও কৃত্রিম আর্থ-সামাজিক সঙ্কট তৈরির অপচেষ্টা হয়েছিল। বর্তমান সময়েও একই ধরনের পাপিষ্ঠ বর্ণচোরা-অনুপ্রবেশকারী-সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনাকারী-কুশীলবদের পরিবার-বশংবদরা অবৈধ দুর্নীতির অর্থে সর্বনিকৃষ্ট পন্থায় সব ‘ম্যানেজ’ করে তাদের প্রতিনিয়ত অসৎ উদ্যোগ কার্যকরণে লিপ্ত রয়েছে। জনশ্রুতিমতে এদের সুনিপুণ অভিনয় শৈলী-ছলচাতুরী- চতুরতায় পারদর্শী-‘ম্যানেজ’ অপসংস্কৃতি চর্চায় পারঙ্গম-লবিং-তদ্বির বাণিজ্যকে ভিত্তি করে অধিকাংশই গোপন আঁতাতের মাধ্যমে দেশবিরোধী কর্মযজ্ঞে সম্পৃক্ত রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘গরিব-দুঃখীর সুখেই স্বাধীনতার সার্থকতা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। ...যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহ্র আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। ...আল্লাহ্র নামে প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতির উর্ধে থাকব।’ প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব।’ প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা দেশকে ভালবাসব, দেশের মানুষকে ভালবাসব, দেশের মাটিকে ভালবাসব।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমণ করে, অস্ত্র নিয়ে আপনাদের মোকাবেলা করে, বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তিসমূহ প্রাসঙ্গিকতায় উচ্চারণ করতে চাই-‘আসিতেছে শুভদিন,/দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ-/...একের অসম্মান নিখিল মানবজাতির লজ্জা- সকলের অপমান!/মহামানবের মহাবেদনার আজি মহাউত্থান,/উর্ধে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান!’ জাতির জনকের অমূল্য ভাষণের আলোকে প্রণিধানযোগ্য যে বিষয়টি সকল সময় স্মরণে রাখতে হবে; দুর্নীতি দমনের নামে নির্দোষ-নিরীহ জনগণকে যেন হয়রানির শিকার হতে না হয়। স্বাক্ষরবিহীন নামসর্বস্ব-বেনামে-ছদ্মনামে কথিত অভিযোগকারীর অসত্য-মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগ আমলে নিয়ে অনৈতিক আর্থিক যোগসাজশ বা অবৈধ সুযোগের লোভে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ব্যক্তিস্বার্থে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও সৎ ব্যক্তিদের অসম্মানিত করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। অভিযোগকারীর যথার্থ নাম, ঠিকানা, পরিচয় ইত্যাদি নিশ্চিত হয়ে যে কোন তদন্ত কার্যক্রম অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। কথিত অভিযোগের নৈর্বৃত্তিক-প্রভাবমুক্ত চূড়ান্ত তদন্তের পরিপূর্ণ সত্যতা নিরূপণ না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রচার সমীচীন নয়; এই ধরনের অপপ্রচারও চরম অপরাধের পর্যায়ে গৃহীত এবং আইনত দণ্ডনীয়। এই শর্ত অবশ্যই যুক্ত করতে হবে যে, অভিযোগকারীর অভিযোগ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়; তাহলে অভিযোগকারীকেও সমুচিত শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। কথিত মিথ্যা অভিযোগ তদন্ত আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের সমাজে সম্মানহানির ঘটনায় যাতে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অভিমান, অসহায়ত্ব এবং হতাশা তাদের আত্মহননে প্ররোচনা বা বিপথগামী না করে, সে দিকে অবশ্যই কঠিন মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে। অতীতে বাংলাদেশে জজমিয়া নাটকসহ কারণে-অকারণে বহু নিরীহ-নির্দোষ মানুষকে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ প্রবণতায় উন্মাদ নষ্ট ব্যক্তিদের জিঘাংসার শিকারে অপরিসীম যন্ত্রণাকাতর, কারাবরণ বা আত্মনিগ্রহে প্ররোচিত হওয়ার দৃষ্টান্তও কম নয়। অতএব আদালত, দুদক বা অন্যান্য বিচারিক কার্যক্রম যাতে কোনভাবেই উল্লেখ্য ঘটনার নৈত্যিক উদাহরণ না হয়; সেদিকে রাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষিত হওয়া খুবই জরুরী। রবি ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে সমস্বরে যেন আমাদের উচ্চারণ করতে না হয়, ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে,/ তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো-অন্তর হতে বিদ্বেষ-বিষ নাশো।’/ বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে/ আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।/ আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে/ হেনেছে নিঃসহায়ে,/ আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ প্রচলিত ধারণা এই যে, শুধু স্বল্প সংখ্যক দুর্বৃত্তরাই শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, বড় মাপের অপরাধীরা কেন জানি বরাবরই অধরায় থেকে যায়। বিভীষণ বা ‘ভূতের মুখে রাম নাম’, অবৈধ পেশী ও অর্থশক্তি, তোষামোদকারী অথবা ভ্রষ্ট রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কথিত লুম্পেন গণতন্ত্রের মোড়কে ভয়ঙ্কর দাপট এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টিকারীদের রুখে দেয়ার জন্য সরকার ও দেশবাসীকে একতাবদ্ধ হতে হবে। একা সরকার প্রধানের পক্ষে সকল ইতিবাচক উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয় যদি না জাতি-রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্ঠীর সমন্বিত শক্তি জোরালো ভূমিকা পালন করে। দেশের নগর-শহর-গ্রামসহ সর্বস্তরের জনপদে উচ্চকিত সচেতনতাই দেশকে করোনার অতিমারীর দুর্বিষহ ক্ষতি পুষিয়ে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধারে অগ্রগণ্য অবদান রাখতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক প্রেরণায় পরিশুদ্ধ নাগরিক এবং দেশপ্রেমিক প্রতিরক্ষা-র‌্যাবসহ সকল সামরিক বেসামরিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ সাহসী উদ্যোগ দেশকে সকল সমস্যা উত্তরণে আলোকময় পথ প্রদর্শন করবে- এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে নিবন্ধের ইতি টানছি। লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×