ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবি-নুর ইনায়েত খান ॥ দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের অপ্রতিরোধী যোদ্ধা

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ২৭ নভেম্বর ২০২০

কবি-নুর ইনায়েত খান ॥ দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের অপ্রতিরোধী যোদ্ধা

চার তরুণীকে বালুর ওপর হাঁটুগেড়ে বসার নির্দেশ দেওয়া হলো। পেছনে জার্মান সৈন্যরা ওদের মাথার দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শবদাহ চুল্লি থেকে নির্গত ধুঁয়ায় ডাখাউ বন্দী শিবিরের আকাশ কালো হয়ে রয়েছে। তিনজন পরস্পরের হাত ধরে রয়েছেন আর এদিকে নুরুন্নেসা নীরবে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এক মিনিট পর মাথার পেছনে গুলি আঘাত করতেই সবাই মারা গেলেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ব্রিটেনের প্রথম মুসলিম নারী সিক্রেট এজেন্ট নুর ইনায়েত খান। রাশিয়ার মস্কোয় ১ জানুয়ারি ১৯১৪ তাঁর জন্ম। পিতা সুফি-সাধক হযরত ইনায়েত খান ছিলেন মহিশুরের টিপু সুলতানের বংশধর। চিশতিয়া সুফি ঘরানার অনুসারী ইনায়েত খান একজন সুফি শিক্ষক এবং সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে ইউরোপে বসবাস করতেন। নুরুন্নেসার মা, পিরানি আমেনা বেগম (অরা মিনা রে বেকার) ছিলেন একজন আমেরিকান। সুফি দম্পতি মেয়ের নাম রাখলেন নুর-উন-নেসা অর্থাৎ ‘নারীত্বের আলো।’ ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ^যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইনায়েত খান সপরিবারে রাশিয়া ছেড়ে লন্ডন চলে আসেন। লন্ডনে ইনায়েত খানের আরও তিন সন্তানের জন্ম হয়। ১৯২০ সালে নুরের বয়স যখন ছয় বছর, তখন ঐ পরিবার ফ্রান্সে চলে যান এবং প্যারিসের উপকণ্ঠেই ‘ফজল মঞ্জিল’ নামে একটি বিশাল বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। খোলামেলা ঐ বাড়িটিতে ক্লাসিকেল সঙ্গীতচর্চা হতো এবং সারা বছরই সুফিসাধকদের আনাগোনা ছিল। চার ভাইবোন ভারতীয় পোশাক পরে সঙ্গীত পরিবেশন করত। ১৯২৭ সালে ইনায়েত খানের মৃত্যুর পর নুরুন্নেসার মা আমেনা বেগম মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েন। তখন তের বছরের নুরুন্নেসাই পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। লাজুক এবং স্বপ্নচারী মেয়েটি সরবোন কলেজে চাইল্ড সাইকোলজি এবং প্যারিস কনসারভেটরিতে বীণা ও পিয়ানো বাজানো শিখতে থাকেন। অন্যদিকে কবিতা আর ছোটদের গল্প লেখাও চললো। বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং ফ্রান্সের রেডিওর জন্য তিনি কবিতা রচনা করে চললেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালে জার্মান বাহিনী ফ্রান্স দখল করার পর, নুরুন্নেসার পরিবার ২২ জুন ১৯৪০ সাগরপথে লন্ডনে পালিয়ে গেলেন। পিতার শান্তিবাদী শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত হলেও, নুরুন্নেসা ও তাঁর ভাই বেলায়েত খান নিপীড়ক নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনীর লড়াইয়ে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। নুরুন্নেসাযোগ দিলেন ওমেন’স অগজিলারি এয়ারফোর্সে। ৫০ জন নারী সদস্যসহ ৫০০ এজেন্ট নিয়ে ব্রিটিশ সরকার স্পেশাল অপারেশন এগজিকিউটিভ নামে একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করেছিল। সমগ্র ‘ইউরোপে বহ্নিশিখা জ¦ালিয়ে দেবার,’ জন্য তাদেরকে শত্রুর সীমান্ত রেখার ভেতরে প্যারাসুটে নামিয়ে দেওয়া হলো। নূর ইনায়েতকেও স্পেশাল এজেন্ট পদে নির্বাচিত করা হলো। ইংল্যান্ডের গিল্ডফোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রশিক্ষণ হলো। ১৯৪৩ সালের জুনের এক অন্ধকার রাতে ছোট্ট একটি বিমানে চড়ে নূর উত্তর ফ্রান্সে অবতরণ করলেন। সঙ্গে একটি সায়ানাইড ক্যাপসুল নিয়ে প্যারিসের পথে চললেন নূর। নুরের সঙ্গে আরও দুজন নারী গুপ্তচর ছিল। ওরা ‘ফিজিশিয়ান নেটওয়ার্ক’ নামে একটি গুপ্ত সংগঠনেযোগ দিলেন। তবে মাস দেড়েক পর নুরুন্নেসা ছাড়া ঐ নেটওয়ার্কের সকল রেডিও অপারেটর জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়ল। বাকি রইলেন কেবল নূর। তিনি যথারীতি বার্তা সংগ্রহ করে অয়ারলেসে লন্ডন পাঠাতে লাগলেন। তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র অয়ারলেস অপারেটার। জার্মান গেস্টাপো বাহিনী হন্যে হয়ে তাকে খুঁজতে শুরু করল। জার্মান ওয়্যারলেস ডিটেকশন ভ্যানগুলোর নজর এড়াতে নূর এক জায়গায় কেবল বিশ মিনিট ধরে মেসেজ পাঠাতে পারছিলেন। ধরা পড়া এড়াতে তিনি সারাক্ষণ জায়গা বদল করছিলেন। পালিয়ে বেড়ালেও লন্ডনের সঙ্গে ঠিকই ওয়্যারলেস যোগাযোগ রেখে চললেন : ‘একসময় তাঁর পদটি ফ্রান্সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক পদ হয়ে দাঁড়াল। তবে তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে তাঁর কাজ করে চললেন।’ দুভার্গ্যবশত রেনে গ্যারি নামে একজন ফরাসি নারী বিশ^াসঘাতক, নুর এনায়েতকে গেস্টাপো বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিল। ১৩ অক্টোবর ১৯৪৩ নুরকে গ্রেফতার করে প্যারিসের গেস্টাপো হেডকোয়ার্টারে তার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। বন্দী থাকা অবস্থায় নুর দুইবার পালাতে চেষ্টা করেছিলেন, তবে ধরা পড়ে গেলেন। এরপর ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪৩ নুর ইনায়েতকে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফর্টশেইম শহরে একটি নির্জন কারাগারে তাকে হাতে-পায়ে শিকল বেঁধে বন্দী করে রাখা হলো। সেই সেলে তিনি দশ মাস বন্দী ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ আরও তিনজন নারী এজেন্টসহ নুরকে কুখ্যাত ডাখাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প স্থানান্তর করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় মাথার পেছনে গুলি করে ঐ চার নারী বন্দীকে হত্যা করা হয়। এরপর তাদের মরদেহ সঙ্গে সঙ্গে শবদাহ চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা হয়। মৃত্যুর আগে নুরের শেষ কথা ছিল, ‘লিবার্টি। মহিয়সী এই নারীর আত্মত্যাগের কারণে ফরাসী সরকার ১৬ জানুয়ারি ১৯৪৬ ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক দেন। এরপর ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশ সরকার মরণোত্তর জর্জ ক্রস পদকে ভূষিত করলেন। তাঁর লন্ডনের বাড়ির কাছেই একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ ভাস্কর্য ৮ নবেম্বর ২০১২ প্রিন্সেস এ্যানি উন্মোচন করেন। এছাড়া ২৫ মার্চ ২০১৪ তাঁর স্মরণে একটি ডাকটিকিট উদ্বোধন করা হয়। ম্যাডলিন নামে প্রতিরোধ যুদ্ধের একজন বীরাঙ্গনা হিসেবে নূর ইনায়েত ফ্রান্সে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। প্যারিসের মেয়র তাঁকে ‘আধুনিক যুগের একজন জোয়ান অব আর্ক’ নামে অভিহিত করে তাঁর প্যারিসের বাড়ির সামনে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছেন। যুদ্ধের আগে নূর ফরাসি রেডিওর জন্য রূপকথার গল্প লিখতেন। ১৯৩৯ সালে বিশটি জাতকের গল্প নামে তাঁর রচিত একটি বই লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। পিয়ানোতে নতুন নতুন সুর তুলে, পরিবারের সকলকে শুনিয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দিতেন। বাবার কাছ থেকে ভারতীয় সুফি সঙ্গীত শুনে সেগুলোর পশ্চিমা স্টাইলের নোটেশনে লিখে রাখতেন। ফরাসি এবং ইংরেজী, উভয় ভাষাতেই লিখতেন। এগার বছর বয়সে ‘লা ভায়োলেট’ নামে ফরাসি ভাষায় একটি কবিতা রচনা করেন। এই কবিতায় তার নিজস্ব স্বকিয়তা ফুটে উঠে। ‘বিনয়ী এবং সৎ ছোট্ট সুন্দর ভায়োলেট তার সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে আমার ছোট্ট বাগানে।’ হাসিখুশি নুর সবসময় গরিব-দুঃখীদের কথা ভাবতেন। একবার বড়দিনে সান্তাক্লজের উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন : ‘এস, এনে দাও উজ্জ্বল সূর্যকিরণ আমাদের সুখী গৃহ আনন্দে ভরিয়ে দাও। প্রত্যেক শিশুকে তার মধুরতম স্বপ্ন দেখাও। সুন্দর পরীদের রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়ে তারপর গরিব মানুষের জীর্ণকুটিরে চলে যেও, তাদের দুঃখী হৃদয়ে আনন্দ দিতে যেখানে সবাই ক্ষুধার্ত। ১৯২৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর ১৫ বছরের নুরুন্নেসা, তাঁর মায়ের উদ্দেশ্যে একটি কবিতা রচনা করেন: আমার আম্মা আমার অতি প্রিয়! সবার প্রিয় আম্মা, আমাদের মনের গভীরে সঞ্চিত একটি রত্ন, এটাই আমাদের কৃতজ্ঞতার ফুল, যে রত্ন কখনও চলে যাওয়ার নয়। দ্যাখো! এর পাপড়িগুলো তৈরি হয়েছে আল্লাহর নিজস্ব স্বর্গীয় শিল্প দিয়ে, আকাক্সিক্ষত এই দিনে এর সৌন্দর্য, তোমাকে আর আব্বার প্রতি নিবেদন করি জীবনযুদ্ধে চলার পথে আর জীবনের নানা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে, আমরা যেন জীবনের এই অমুল্য রতনকে সযত্নে ধরে রাখতে পারি আমাদের মনে যে বীজ তুমি বপন করে দিয়েছ, আহা! তা পবিত্র নর্তনে উদ্ধৃত, আর সবসময় মনে রেখ: হৃদয়ের চলার পথ কন্টকাকীর্ণ, অবশেষে যা শান্তির পথে নিয়ে চলে। ‘দি সং অব দি ওশেন,’ এবং ‘দি সং অব দি নাইট,’ নামে আরো দুটো কবিতায়, গভীর বেদনার সুর ফুটে উঠেছে। এর পরের কবিতায় নূর লিখেছেন: ‘কে আমার বেদনার কান্না শুনেছে, কে আমার দীর্ঘশ^াস শুনেছে. . .’ এই লাইনটিতে তার তখনকার মনের আবেগ উঠে এসেছে। এদিকে সঙ্গীতচর্চাতেও নূর বেশ এগিয়ে চললেন। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটি চলাকালীন সুফি ইনায়েত খানের চার সন্তান ‘ফজল মঞ্জিলে’ কনসার্ট পরিবেশন করতেন। সারা পৃথিবী থেকে আগত সুফিগণ দর্শকশ্রোতা ছিলেন। চার ভাইবোন বেহালা, সেলো, পিয়ানো এবং বীণা বাজাতেন। ১৪ বছর বয়সে রচিত আরেকটি কবিতা: ‘একদা এক মৎস্যকন্যা জাহাজ নিয়ে চলল উত্তাল সাগরে, সে ভেসে চললো, উথালপাথাল ঢেউ উঠছে আর লাফাচ্ছে উল্লাসে, তবে জাহাজে সে একটি প্রদীপ জ¦ালিয়েছে যার আলো এমনই সুমিষ্ট, যে, সেই আলো জ¦লতে যেই দেখে. তার মন খুশিতে নেচে উঠে।’ দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের এতবছর পরও নূর ইনায়েত খানের গল্পটি নতুন প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাদের কথা ওরা জানতে পারে।
×