ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণময় অধ্যায়ের সমাপ্তি (১৯৬০-২০২০)

ফুটবলের বিস্ময় প্রতিভা ম্যারাডোনা

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৭ নভেম্বর ২০২০

ফুটবলের বিস্ময় প্রতিভা ম্যারাডোনা

জিএম মোস্তফা ॥ ডিয়েগো ম্যারাডোনা মানেই প্রবল কৌতূহল, দুর্নিবার আকর্ষণ। ম্যারাডোনা মানেই রোমাঞ্চকর খবর। ফুটবল পায়ে যেমন প্রতিপক্ষকে ভেঙ্গেচুরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গেছেন তিনি, তেমনি মাঠের বাইরে ভাবনার প্রকাশেও তার লাগাম থাকত সামান্যই। আচরণে আর কণ্ঠে সবসময়ই নিজেকে মেলে ধরেছেন তিনি ঠিক নিজের মতো করেই। তবে সবকিছুকে স্তব্ধ করে বুধবার পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ফুটবলের বরপুত্র। জীবনের অনিবার্য নিয়ম মেনে ফুটবল ঈশ্বর চলে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে। আর্জেন্টাইন ফুটবলের কিংবদন্তির মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই কাঁদছে বুয়েন্স আইরেস। কাঁদছে আর্জেন্টিনা। গোটা ফুটবল দুনিয়ার চিত্রটাও অভিন্ন। বাংলাদেশসহ তার শূন্যতার শোকে ভাসছে গোটা পৃথিবী। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর এক কারখানা শ্রমিকের ঘরে জন্ম ম্যারাডোনার। বাবা-মায়ের ৮ সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ম্যারাডোনার কোনকিছু বোঝার আগেই ফুটবল প্রেমের শুরু। উপহার পাওয়া ফুটবল নিয়ে ঘুমাতে যেত ছোট্ট ডিয়েগো। বস্তিতেই তার ফুটবল খেলার শুরু। দারিদ্র্য পীড়িত জীবনে মুক্তির অবলম্বন ছিল কেবলই ফুটবল। ৮ বছর বয়সে তার ফুটবল প্রতিভা চোখে পড়ে এক স্কাউটের। তিনিই ম্যারাডোনাকে নিয়ে যান আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ক্লাবে। পরের গল্পটা তো সবারই জানা। কেবলই ফুটবল জাদুতে মুগ্ধ করার পালা। ১৬তম জন্মদিনের আগেই ওই ক্লাবের হয়ে আর্জেন্টিনার প্রিমেরা ডিভিশনে অভিষেক। প্রতিভার ঝলকে ১৬ বছর বয়সেই অভিষেক হয়ে যায় আর্জেন্টিনার হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে। তখনই এক আগমনী বার্তা পেয়ে যায় বিশ্ব ফুটবল। তাকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় তোলপাড়। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে ৫ বছরের অধ্যায় শেষে ১৯৮১ সালে যোগ দেন বোকা জুনিয়র্সে। শৈশবের ক্লাবের জার্সিতে অভিষেকেই জোড়া গোল করে ম্যারাডোনার বাজিমাত। পরের বছরই সেই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে নতুন করে ঠিকানা গড়েন বার্সিলোনায়। সে বছরেই ১৯৮২ বিশ্বকাপ। সম্ভাব্য নায়কদের একজন হয়ে বিশ্বকাপযাত্রা। বড় মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি সেবার। ক্লাব ফুটবলে তার বার্সিলোনা অধ্যায়টাও খুব একটা সফল হয়নি। ১৯৮৪ সালে ট্রান্সফার ফির আরেক দফা রেকর্ড গড়ে পা রাখেন নেপোলিতে। ক্লাব আর দেশের হয়ে এটাই তার সেরা সময়ের সূচনা। নেপোলিতে দ্রুই সমর্থকদের ভালবাসা জয় করে নেন ম্যারাডোনা। পেয়ে যান অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ডও। তার নেতৃত্বেই প্রথম সিরি’এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পায় নেপোলি। পরে আরও একটি সিরি’এর পাশাপাশি ক্লাবকে দুইবার রানার্সআপ করেন তিনি। মাঝারি শক্তির দলকে ইতালিয়ান ফুটবলে পরাশক্তি করে তুলে নেপলসের রাজা হয়ে ওঠেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মিশন শুরু করেন ম্যারাডোনা। সেই যেন অমরত্বের পথে তার পদচারণা শুরু। চমকপ্রদ পারফর্মেন্সে শিরোপা এনে দেন দলকে। গোল করেন ৫টি সমান ৫ গোলে সহায়তাও তার। তবে এসব পরিসংখ্যানে ম্যারাডোনার সেই জাদুকরী ফুটবল নৈপুণ্যের কিছুই বুঝানো যাবে না। মোটকথা ঐন্দ্রজালিক ফুটবলে সেবার মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন গোটা বিশ্বকে। অধিনায়কত্ব ছাপিয়ে হয়ে ওঠেন একজন সত্যিকারের নেতা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করে কিংবদন্তির উচ্চতায় উঠে যান। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় প্রথম গোলটি ছিল হেড করতে গিয়ে হাত দিয়ে করা। পরে যা পরিচিতি পায় ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে। হাত দিয়ে গোল করার মিনিট চারেক পরই ৫ জনকে কাটিয়ে পরে গোলকিপারকেও কাটিয়ে গোল করেন আরেকটি। ফিফার জরিপে যা বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরার পাশাপাশি শতাব্দীরও সেরা গোল নির্বাচিত হয়। সেমিতে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও জোড়া গোল। এই ম্যাচেও অবিশ্বাস্য ড্রিবলিং আর দারুণ কৌশলগত দক্ষতার নিপুণ প্রদর্শন। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি তাকে কড়া মার্কিংয়ে রাখে পুরোটা সময়। তার পরও দলের জয়সূচক গোলটি আসে তার পাস থেকে। এটাই যেন ডিয়েগো ম্যারাডোনার অমরত্ব পাওয়ার দিন। ম্যারাডোনার জন্য এক অদ্ভুত আবেগ অনুভব করেছে বাংলাদেশ। সবসময়ই। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে গোটা বাংলাদেশেরই কায়মনো প্রার্থনা ছিল আর্জেন্টিনার জয়। সেটি যতটা না আর্জেন্টিনার তারচেয়েও বেশি ম্যারাডোনার। রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে যখন সেটি হলো না তখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল সারাদেশ। সাত সমুদ্র-তেরো নদী এপারের এই ছোট্ট ভূখণ্ড যেন পারলে মেক্সিকান রেফারি মেন্ডেজকে কাঁচা খেয়ে ফেলে। ম্যারাডোনার কষ্টে সম্পৃক্ততা প্রকাশ করে পোস্টার-ভিউকার্ডে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বাড়িতে দরজায়, দেয়ালে শোভাপেত ম্যারাডোনার বিভিন্ন আঙ্গিকের ছবি, কান্নাভরা মুখ। এমন অবাক ভালবাসার নজির পৃথিবীতে সত্যিই বিরল।
×