ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জুমার দিনে জঙ্গীবাদ নিয়ে বয়ান না দেয়া ইমামদের তালিকা হচ্ছে

কিছু মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২৭ নভেম্বর ২০২০

কিছু মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর নতুন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বেশ কিছু মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসা ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। পবিত্র জুমার নামাজের খুতবার আগে জঙ্গীবাদ নিয়ে বয়ান না দেয়া ইমামদের একটি পৃথক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। আর নামাজ শেষে মসজিদে বয়ানকারীদের এবং শ্রোতাদের বয়স ও লেবাস সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। সরকার সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ দমনে পারদর্শিতা দেখাতে পারলে তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণাও দিয়েছে। পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জঙ্গী মনিটরিং সেল। গত ২৩ নবেম্বর জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধ, নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিশেষ এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। এজন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সা.) সমাজ থেকে ভয়, অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা ও সংঘাত দূর করে শান্তি, নিরাপত্তা এবং সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইসলামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ধ্বংস করার উদ্দেশে কোন অশুভ শক্তি একেক সময় একেক নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাসীর কোন ধর্ম নেই, সীমানা নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসিরসহ আলেম-ওলামার মাধ্যমে পবিত্র কোরান ও হাদিসের আলোকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী বক্তব্য প্রস্তুত করবে। সেই বক্তব্য দেশের সকল স্থানীয় পর্যায়ের মসজিদের খতিব-ইমামের মাধ্যমে নিয়মিত প্রচার নিশ্চিত করতে হবে। সব মসজিদের খতিব-ইমামরা জুমার নামাজের খুতবার পূর্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী বক্তব্য প্রচার নিশ্চিত করবেন। পবিত্র কোরান ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা সংবলিত বক্তব্য অনলাইন তথা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সব শ্রেণীর জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সভা-সমাবেশ আয়োজনের উদ্যোগ নিতে সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা জরুরী পদক্ষেপ নেবেন। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের পরিচালক (সমন্বয়) মোহাম্মদ মহীউদ্দিন মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে তাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠির আলোকে সারাদেশে তারা নতুন করে জোরালো তৎপরতা শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে লিখিত চিঠির পাশাপাশি মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো হয়েছে। দেশের প্রতিটি বিভাগ থেকে শুরু করে থানা পর্যায় পর্যন্ত তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে। সেই নেটওয়ার্ক কাজে লাগানো হচ্ছে। পাশাপাশি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, থানা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রতিটি থানায়ও সরকারী নির্দেশনার চিঠি পৌঁছানো হয়েছে। সম্মিলিতভাবে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে নতুন করে জোরালোভাবে কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, সারাদেশে মসজিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। যার মধ্যে ৮২ হাজার মসজিদ সরাসরি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে। মসজিদগুলোর ইমামদের বেতন দিয়ে থাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রতিবছর ইমামদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ ইমাম তাদের অধীনে রয়েছেন। বাকি আড়াই লাখ মসজিদের ইমামদের তারা সরাসরি দেখভাল করেন না। তবে সরকারী যেকোন আদেশ বা নির্দেশনা তাদের কাছেও পাঠানো হয়। অনেক মসজিদের ইমাম সরকারী নির্দেশনা মেনে জুমার নামাজের আগে জঙ্গীবাদ বিরোধী বয়ান দেন। আবার অনেকেই দেন না। যারা দেন না, তাদের বিষয়ে নজর রাখতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগ, জেলা প্রশাসন, থানা পর্যায়ের থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বিভাগ থেকে শুরু করে থানা পর্যায় পর্যন্ত তাদের লোকজন রয়েছে। তাদের মাধ্যমে সারাদেশের মসজিদের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খবর রাখা হচ্ছে। এছাড়া মসজিদভিত্তিক পাঠাগার ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সেখানে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের মাধ্যমেও খবর রাখা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে তাদের নিজস্ব পরিদর্শক রয়েছে। তারা ছদ্মবেশে মসজিদে মুসল্লি সেজে অবস্থান করে প্রকৃত চিত্র জানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি থানাভিত্তিক মসজিদের তালিকা মোতাবেক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তিনি জানান, বিভিন্ন সরকারী অফিসে থাকা মসজিদের ইমামরা পবিত্র খুতবার নামাজের আগে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ বিরোধী বয়ান দিয়ে থাকেন। এজন্য এসব মসজিদ ছাড়া অন্যান্য মসজিদে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। অনেক আগ থেকেই এমন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারির পর সেই কাজ আরও গতিশীল করা হয়েছে। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র বলছে, দেশ থেকে জঙ্গীবাদ নির্মূল করতে ২০০৯ সালের প্রথমদিকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জঙ্গী মনিটরিং সেল গঠন করা হয়। দেশকে জঙ্গীবাদ মুক্ত করতেই সেলটি কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য দেশের সকল বিভাগকে মনিটরিং সেলের সদস্য করা হয়েছে। সেলটির সদস্য করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরের প্রতিনিধি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরকে। প্রতিটি সেক্টরের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদ বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানের সকল অনুষ্ঠানে ও এ্যাসেম্বলি ক্লাসের আগে জঙ্গীবাদবিরোধী বক্তব্য দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদ নিয়ে কথা না বললে তাদের সরকারী সুযোগ-সুবিধা না দেয়ার বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মধ্যে আছে দেশের সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীবাদ বিরোধী প্রচার চালানো। এমনকি প্রচার চালানো হয় কি-না তা মনিটরিং করা। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে কোন জঙ্গী সংগঠনের বিস্তার ঘটতে না পারে, এজন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং সকল গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়মিত তদারকি করা।
×