ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের মতবিনিময় সভা

সঙ্কট মোকাবেলা করে ফের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসবে দেশ

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২৭ নভেম্বর ২০২০

সঙ্কট মোকাবেলা করে ফের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসবে দেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রতিঘাত মোকাবেলা করে বাংলাদেশ আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। এছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট বলে জানিয়েছে সরকার। করোনায় জীবনহানি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ইতোমধ্যে টিকা কেনার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে করোনার প্রথম ধাপে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়। ওই সময় রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়া, শিল্পখাতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়া, রেমিটেন্স আহরণ হ্রাস, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা তৈরি এবং গার্মেন্টস পণ্য রফতানি কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এতে করে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। সরকার ঘোষিত ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে সমস্যাগুলো কেটে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ’ শীর্ষক সিরিজ মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। প্রথম সভার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এবং অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা’। অনুষ্ঠানে বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রধান অতিথি হিসেবে ওই সভায় বক্তব্য রাখেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক, বাংলাদেশ-ভুটানের বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিস মার্সি মিয়াং টেম্বন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত মি. ইতো নাউকি প্রমুখ। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, কোভিড-১৯ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রয়েছে। সরকারের প্রচেষ্টায় মানুষ সচেতন হচ্ছে, ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্বলিত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য এ সকল পদক্ষেপ খুব প্রয়োজন ছিল। সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়েছে। তিনি বলেন, এ সময়ে দেশের নিত্যপ্রয়াজনীয় পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ এবং মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সরকার সক্ষম হয়েছে। প্রয়োজনে টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রয় করা হয়েছে। ফলে কঠিন পরিস্থিতিতেও দেশে কোন পণ্যের সঙ্কট হয়নি বা মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি। তিনি বলেন, চীনে কোভিড-১৯ শনাক্তের পর মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে শনাক্ত হয়। দেশে ৬৬ দিন সরকারী ছুটি কার্যকর ছিল। প্রয়োজনে সরকার অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অর্থনীতির ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে নিতে হয়েছে অনেক পদক্ষেপ। সে কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও করোনা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এছাড়া করোনা থেকে জীবন বাঁচাতে টিকা কিনতে চলতি বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আশা করছি, টিকা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দ্রুত এই টিকা পাবে। বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনার সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এখন আবার দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউনে চলে গেছে। এতে করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে পোশাক রফতানি ও রেমিটেন্স আহরণ আবার চাপের মুখে পড়তে পারে। সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এ কারণে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দেয়া উচিত। পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের পোশাক খাত। প্রথম দফায় রফতানি অর্ডার কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। তবে প্রণোদনায় সেই সময় স্বস্তি ফিরে আসে দেশের প্রধান রফতানি খাতে। এখন আবার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। এ শিল্পের উৎপাদন, রফতানি ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে এ মুহূর্তে সরকারী নজরদারি প্রয়োজন। আশা করছি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায়ও সরকার গার্মেন্টস শিল্পের পাশে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ-ভুটানের বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিস মার্সি মিয়াং টেম্বন বলেন, করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায়ও সংস্থাটি বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তিনি বলেন, দেশের অবকাঠামো উন্নয়নসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে সব সময় সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। আগামীতেও সহায়তা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত মি. ইতো নাউকি বলেন, জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। এদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে জাপান সরকার বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এ কারণে গাড়ি উৎপাদনসহ নানা খাতে জাপান বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হচ্ছে। এতে করে জাপানী উদ্যোক্তারা নতুন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে এখানে আসতে পারবেন। সভায় মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ হতে জীবন বাঁচাতে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ লকডাউনে চলে যায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ওই সময় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল এবার বিশ্বে বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩-২০ ভাগ কমে যেতে পারে। জাতিসংঘের আঙ্কটাড ৫-১৫ শতাংশ বিনিয়োগ কম হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে। তাদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। কারণ করোনা লকডাউনে এদেশের পণ্যের চাহিদা কমে যায়। উৎপাদন ও সেবামূলক খাতে চাপে পড়ে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গার্মেন্টস খাতের মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি হ্রাস পায়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়, রাজস্ব আদায় কমে যায়। তবে ওই সময় জরুরী ভিত্তিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নেয় এর মধ্যে করোনা থেকে জীবন বাঁচানো সবার আগে। এর পাশাপাশি ক্ষুধা দূর করা, কর্মসংস্থান ধরে রাখা এবং কিভাবে এ সঙ্কট থেকে দ্রুত উত্তরণ করা যায়। এছাড়া করোনার টিকার জন্য চলতি বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়। এছাড়া সরকারী ব্যয় কমিয়ে আনা, প্যাকেজ বাস্তবায়ন সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো এবং টাকার সরবরাহ বাড়ানোর মতো কর্মসূচী গ্রহণ করে সরকার। প্রসঙ্গত, কোভিড-১৯ উদ্ভূত সঙ্কট মোকাবেলা ও ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। এর আওতায় সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্বলিত মোট ১ লাখ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যার বাস্তবায়ন বর্তমানে চলমান রয়েছে।
×