ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়েই বেঁচে থাকবেন ম্যারাডোনা

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২৭ নভেম্বর ২০২০

অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়েই বেঁচে থাকবেন ম্যারাডোনা

জিএম মোস্তফা ॥ একজন ফুটবলার একটি ক্লাব কিংবা দেশকে যে সুউচ্চে তুলে ধরতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ডিয়েগো ম্যারাডোনা। বিরল ক্ষমতায় শৈল্পিক নৈপুণ্যে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন ফুটবলের আলো। অবশেষে বুধবার জীবনপ্রদীপ নিভে গেল তার। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন ম্যারাডোনা। পরিবার থেকে বুয়েনস এয়ার্সের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল তার মস্তিষ্কে। একটু সুস্থ হতেই ফের বাড়ি ফেরেন। বুধবার নিজ বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে চিরবিদায় নেন ফুটবলের এই জাদুকর। ম্যারাডোনার মৃত্যুর প্রায় দুইদিন কেটে গেছে। তথাপি এ বাক্যটা বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু অমোঘ সত্য মেনে নিতে হচ্ছে সবাইকে। তার বিদায়ে গোটা দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীরা শোকে বিহ্বল। আর্জেন্টিনায় রাস্তায় নামে কান্নার রোল। এরই মাঝে ম্যারাডোনার মৃত্যুর নানা আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেন সংশ্লিষ্টরা। ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় সময় ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ১১টায় ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শেষকৃত্যের জন্য প্রস্তুত করতে। ম্যারাডোনাকে একনজর দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল আর্জেন্টাইন সময় রাত ১টা ৩০ মিনিটে। প্রথমেই ম্যারাডোনাকে দেখেন প্রথম স্ত্রী ক্লদিয়া ভিয়াফোন ও দুই কন্যা দালমা ও জিয়ানিন্না। তার কিছুক্ষণ পর ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্যরা এসে শ্রদ্ধা জানান। স্থানীয় সময় ২৬ অক্টোবর সকাল ৬টায় বিদায় জানাতে কাসা রোসাদার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ম্যারাডোনার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই রাস্তায় নেমে আসেন ভক্তরা। আর্জেন্টিনা ছাড়াও বিভিন্ন শহরের রাস্তায় বানানো হয় আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ এনে দেয়া দিয়েগো ম্যারাডোনার প্রতিকৃতি। সেখানে তারা মোমবাতি জ্বেলে, ফুল দিয়ে শেষবার শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কিংবদন্তিকে। বুয়েন্স এয়ার্সের কাসা রোসাদা ছাড়াও অবেলিস্ক, সান ফার্নান্দো এবং লা বোম্বোনেরায় জড়ো হন ভক্তরা। বৃহস্পতিবার আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের আবাসস্থল কাসা রোসাদায় রাখা হলে আর্জেন্টিনার সাধারণ মানুষ শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে দলে দলে হাজির হন। যে মানুষটি জীবনভর তাদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, আবেগে ভাসিয়েছেন, তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য ছুটে চলেন সবাই। কিংবদন্তির মৃত্যুতে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার শেষকৃত্য নিয়ে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দেজ বলেন, ম্যারাডোনার সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তার পরিবার যেভাবে চায় সেভাবেই সব হবে। তবে ভুলে গেলে চলবে না আমরা মহামারীর মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের সংগঠিত হতে হবে। গভর্নমেন্ট হাউসে তার শেষ শ্রদ্ধার আয়োজন করতে যাচ্ছি, যেন সেখানে লাখ লাখ মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারে। রাতের একাকিত্ব ঘোচাতে আকাশে তারা জ্বলে। কিন্তু খেলা না থাকলে স্টেডিয়ামের একাকিত্ব কি ঘোচে? আলো কি জ্বলে? সচরাচর জ্বলে না। তবে বুধবার রাতে আর্জেন্টিনার বেশ কিছু বড় স্টেডিয়ামেই জ্বলেছিল আলো ম্যারাডোনার সম্মানে। বোঝানো হয় এভাবেই উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন ম্যারাডোনা আর্জেন্টাইনদের মনে। ফুটবলের ঈশ্বর হয়ে। ম্যারাডোনার বিশ্ব ফুটবলে উত্থান আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স থেকে। এরপর খেলেছেন বোকা জুনিয়র্সে। ম্যারাডোনার সম্মানে প্রথমে স্টেডিয়ামের আলো জ্বালিয়ে ভিন্নধর্মী শ্রদ্ধা জানায় ইতালির নেপোলসের ভক্তরা। ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনা সেরা সময় কাটিয়েছেন নেপোলিতে। আর্জেন্টাইন ঈশ্বর নেপোলসের মানুষের কাছেও তাই ঈশ্বর। তারা তাই প্রথম সান পাওলোতে আলো জ্বালিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়। এরপর আর্জেন্টাইন ক্লাবগুলোও একই কাজ করে। স্টেডিয়ামের আলো জ্বালিয়ে শেষ সম্মান জানান কিংবদন্তিকে। একে একে আর্জেন্টিনো জুনিয়র্স, বেলগ্রানো, কুইলমেস, ইন্সটিউটো, টেম্পারলি, সেন্ট্রাল করদোবা দে সান্তিয়াগো দেল স্তেরো, ইউনিয়ন, ভ্যালেজ, ফেররো, ব্যানফিল্ড, লস আন্দেস, রেসিং ডি করদোবা, চাকো ফর এভার, সারমিন্তো দে চাকো, ইন্দিপেন্দিয়েন্তে, জেনারেল পাজ জুনিয়র্স এবং বোকা জুনিয়র্স তাদের স্টেডিয়ামের আলো জ্বালিয়ে রাখে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা মনোমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বকে। মেক্সিকো বিশ্বকাপের আলো-আঁধার দুইই ম্যারাডোনার। আঁধারটুকুকে কেউ যদি বলেন হাত দিয়ে গোল, ভক্তরা বলবেন সে তো চাঁদের কলঙ্ক, ওটুকু না থাকলে জীবনের কী মর্ম! জীবন তো আর একমুখী স্রোতের বহতা নদী নয়, সে নানারকম বাঁকের খেরোখাতা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার সেই হাত দিয়ে গোল (হ্যান্ড অব গড) তেমনই এক বাঁক যা বিতর্ক নয়, আদরের সঙ্গে মনে করা হয়। সেই বিশ্বকাপের ছোঁয়া লেগেছিল বাংলাদেশেও। মূলত ওই বিশ্বকাপ থেকেই, ওই প্রজন্ম থেকেই এদেশে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পতাকা ওঠে ছাদে। ম্যারাডোনার ওই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটি আইকনিক হয়ে ওঠে। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও তিনি আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন। কিন্তু সেরা হতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে ফুটবলকে বিদায় জানানোর পর কোচিং শুরু করেছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মেসিদেরও কোচ ছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফি জেতাতে পারেননি। ব্যক্তি জীবনে যেমন সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিলেন তেমনি বিতর্কও তার কখনও পিছু ছাড়েনি। প্রায়ই থাকতেন খবরের শিরোনামে। পার্টি-ড্রাগ এসবের নেশায় মত্ত হয়ে থাকতেন তিনি। একদিকে যেমন বাঁ পায়ের জাদু তেমনি আরেকদিকে বিতর্ক ছিল তার চিরসঙ্গী। ফুটবলীয় জাদু যেমন তার জীবন-মুদ্রার একপাশে দিয়েছে অমরত্ব, অপরপাশের রাশি রাশি বিতর্ক যেন সেই অমরত্বকে করেছে আরও সুস্বাদু। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে গোল করে ভয়ঙ্কর উদযাপনের কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পাত্তা দেননি ফিফার নিষেধাজ্ঞাকেও। বরং মাদক নিয়ে নিষিদ্ধ হয়েও ফিফার নানা বিতর্কিত কাজের সমালোচনা করতে তার কখনও এতটুকু বাধেনি। নারীসঙ্গ ছাড়াও তার কিছু অদ্ভুত শখ ছিল। একইসঙ্গে দুই হাতে দুটি ঘড়ি পরতেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার বাহুতে ছিল চে গোয়েভারা এবং বাঁ পায়ে ফিদেল কাস্ত্রোর ট্যাটু। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যারাডোনা ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন। চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন তিনি। পেশাদার ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনা জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সিলোনা, নেপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন। কোচ হিসেবে খুব কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ২০০৮ সালের নবেম্বরে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দেয়া হয় ম্যারাডোনাকে। ২০১০ বিশ্বকাপের পর চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আঠারো মাস এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে প্রায় একাই শিরোপা জেতানো ছাড়াও ইতালিয়ান ক্লাব নেপোলির হয়ে স্মরণীয় মৌসুম উপহার দিয়েছেন ম্যারাডোনা। নেপোলিকে দুইবার সিরি’এ ও উয়েফা কাপ জিতিয়েছিলেন এই ফুটবলের জাদুকর। তাই প"থিবী থেকে বিদায় নিলেও ম্যারাডোনা অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবেন সকলের হৃদয়ে।
×