ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

বিদায় ঐন্দ্রজালিক ফুটবলার

প্রকাশিত: ২১:০২, ২৭ নভেম্বর ২০২০

বিদায় ঐন্দ্রজালিক ফুটবলার

সারা দুনিয়ার কোটি কোটি ভক্তের হৃদয় ভেঙ্গে চলে গেলেন কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়াগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। মাত্র ৬০ বছর বয়সে তিনি গত ২৫ নবেম্বর স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা নাগাদ আর্জেন্টিনার বুয়েন্সআয়ার্সে তার নিজ বাসভবনে মারা গেছেন। তার মৃত্যুতে গোটা বিশ্বে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। হবেই বা না কেন! ফুটবলের রোমাঞ্চকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাখতে ম্যারাডোনা যে একজন নিপুণ কারিগর। ব্যক্তি ম্যারাডোনা নিষ্কলঙ্ক র্ছিলেন না ঠিকই কিন্তু বরাবরই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিভাবান ফুটবলার বলতে আমরা যা বুঝি ম্যারাডোনা ছিলেন তাই। এই মিডফিল্ডারের গতি ছিল চোখ ধাঁধানো। অসাধারণ নান্দনিক ড্রিবলিং আর সারা মাঠে নিজের আধিপত্য বিস্তার তাকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়। ফুটবল একটি শিল্প আর এর স্রষ্টা মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা এই আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা তার ফুটবল জীবনের শুরুর দিকে লোস কাবালিও যুব দলে খেলার সময় তার খেলোয়াড়ি নিপুণতায় টানা ১৩৬টি ম্যাচে সে দলটি অপরাজিত ছিল। ম্যারাডোনা ৪৯১টি ম্যাচে ২৫৯টি গোল করেছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় এই ফুটবল মানবের। ১৯৭৮ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়েও শেষ পর্যন্ত খেলা হয়নি তার। বয়স কম হওয়ার কারণে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়েন ফুটবলের অতিমানব দিয়াগো ম্যারাডোনা। ১৯৭৯ সালের ২ জুন জাপানে অনুষ্ঠিত যুব বিশ্বকাপে প্রথম আন্তর্জাতিক গোল করেন ম্যারাডোনা। সেবার তার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা ঐ শিরোপা লাভ করে। ১৯৮১ সালে ১ মিলিয়ন ইউরোতে বোকা জুনিয়র্সে নাম লেখান ম্যারাডোনা। ওই বছরই প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়নশিপের স্বাদ গ্রহণ করেন আর্জেন্টিনার সুপারস্টার। ১৯৮২ সালে প্রথমবার অংশ নেন বিশ্বকাপে। ব্রাজিলের কাছে ৩-১ ব্যবধানে হেরে আর্জেন্টিনা বিদায় নেয়। সে বছরই ঠিকানা বদল করে ৫ মিলিয়ন ইউরোতে যোগ দেন বার্সেলোনায়। তিন বছর সেখানে কাটিয়ে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন। ১৯৮৪ সালে স্পেন ছেড়ে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন ম্যারাডোনা। রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি ৪.৬৮ পাউন্ডে সিরি এ ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি। এরপর ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। চারদিকে শুধু ম্যারাডোনার জয়জয়কার। প্রায় একার কৃতিত্বে তিনি ৮৬’র বিশ্বকাপ ফুটবল শিরোপা আর্জেন্টিনার হাতে এনে দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐ খেলায় ‘ঈশ্বরের হাত’ নামে সেই গোলের জন্য তিনি নিন্দিত হয়েও হয়েছিলেন বিখ্যাত। তবে একই খেলায় চার মিনিট পর অসাধারণ নৈপুণ্যে পাঁচজন ইংলিশ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে, গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে বোকা বানিয়ে পরবর্তী গোলটি করেছিলেন। ম্যারাডোনার সেই গোল ফিফা বিশ্বকাপে ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করে এবং ২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে গোলটি শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়। সে বছর বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ম্যারাডোনা পান গোল্ডেন বল। পাশাপাশি ওই বছর ইউরোপের সেরা ফুটবলারও নির্বাচিত হন এই আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। ১৯৯০ বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনার দায়িত্ব ছিল ম্যারাডোনার ওপর। কিন্তু গোড়ালির ইনজুরির কারণে ম্যারাডোনার পারফরম্যান্স ভাল ছিল না। আমার বয়স তখন ১০ বছর। খেলা দেখতে গিয়েছিলাম উপজেলা কমপ্লেক্স ক্লাবে। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে ফাইনাল খেলায় আর্জেন্টিনার হারের পর পুরো পথ কাঁদতে কাঁদতে গভীর রাতে বাসায় ফিরেছিলাম। তখনই মনে হয় ফুটবলকে সত্যিকার অর্থে ভালবেসেছিলাম। আর ম্যারাডোনা হয়েছিলেন আমার ফুটবল নায়ক। বিপ্লবী চেতনার মানুষ ম্যারাডোনা পুঁজিবাদের বিপক্ষেই ছিলেন। চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ত্রো ছিলেন তার আদর্শ। কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে ক্যাস্ত্রো এবং ম্যারাডোনা একই দিনে মারা গিয়েছেন, তফাৎ শুধু চার বছর আগে পরে। ১৯৮৪ সালের ৭ নবেম্বর, বুয়েনোস আইরেসে ফিয়ান্সি ক্লদিয়া ভিয়াফানিয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ম্যারাডোনা। ২০০৪ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ২০০৫ সালের ১৫ আগস্ট, আর্জেন্টিনার একটি টেলিভিশনের টকশো ‘La Noche del 10’ এর উপস্থাপক হিসেবে ম্যারাডোনার ছোট পর্দায় অভিষেক হয়। প্রথম শোতে ম্যারাডোনার অতিথি ছিলেন আরেক কিংবদন্তি খেলোয়াড় পেলে। ফুটবল মাঠের দুই সুপারস্টারের অনুষ্ঠান এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে দ্বিতীয় পর্বের জন্য মিছিল করেছিল সমর্থকরা। ফুটবলের অন্যান্য তারকাদের মধ্যে ম্যারাডোনার অতিথি হয়েছিলেন জিনেদিন জিদান, রোনাল্ডো প্রমুখ। সে বছর আর্জেন্টিনায় সামিট অফ দ্য আমেরিকাস-এ আর্জেন্টিনায় জর্জ ডব্লিউ বুশের উপস্থিতির বিরোধিতা করে একটি টি-শার্ট পরেছিলেন ম্যারাডোনা, যাতে লেখা ছিল STOP BUSH। তার মৃত্যুতে বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান, খেলোয়াড় থেকে শুরু প্রায় সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকবার্তা দিয়েছেন। শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং যুগে যুগে তার ক্রীড়া নৈপুণ্য ভবিষ্যত ফুটবল খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।’ ম্যারাডোনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফ্রান্সের ফুটবল তারকা এমবাপ্পে লিখেছেন, ‘ফুটবলের ইতিহাসে চিরকাল তুমি থেকে যাবে। পুরো বিশ্বকে তুমি যেভাবে আনন্দ দিয়েছ তার জন্য ধন্যবাদ।’ ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাশরাফি লিখেছেন ‘শোকের পরে শোক চলছে। তোমার থেকে বড় সুপারস্টার আমার চোখে আর কেউ ছিল না, আর আসবেও না। ব্যক্তিজীবনে তুমি আমার একমাত্র সুপারস্টার ছিলে যাকে আমি একবার হলেও সামনে থেকে দেখতে চেয়েছিলাম। তোমার বাঁ-পায়ের আঁকা নিখুঁত গোলের ছবিগুলো মনের ক্যানভাসে থেকে যাবে আজীবন। ভাল থেক ওপারে জাদুকর। দি ড্রিবলিং মাস্টার দিয়াগো আরমান্দো মারাদোনা (RIP) ।’ ভারতীয় কিংবদন্তি ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী টুইট বার্তায় লেখেন, ‘আমার হিরো আর নেই। আমার বিশ্বাস ফুটবল কিংবদন্তি পরপারে শান্তিতে থাকবেন। আপনার জন্যই আমি ফুটবল দেখেছি।’ সত্যিই অনেকেই ফুটবলের প্রেমে পড়েছে ম্যারাডোনার পায়ের নান্দনিক কারুকার্যে। পৃথিবীতে ফুটবল থাকবে যতদিন তুমিও থাকবে ততদিন। জয়তু ম্যারাডোনা। লেখক : সাংবাদিক
×