ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেহাল মর্গ-ময়নাতদন্ত

প্রকাশিত: ২১:০৮, ২৬ নভেম্বর ২০২০

বেহাল মর্গ-ময়নাতদন্ত

ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ঘৃণা ও বিবমিষায় ভরে ওঠে শরীর-মন। খোদ রাজধানীর বুকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে একাধিক কিশোরীর মৃতদেহের সঙ্গে জনৈক ডোমের শারীরিক সংসর্গের প্রমাণ মিলেছে সিআইডির হাতে। সিআইডি বলেছে, গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত উক্ত ডোম অন্তত ছয় কিশোরীর মৃতদেহ সম্ভোগ করেছে। সবই ছিল আত্মহত্যার ঘটনা। সে উক্ত হাসপাতালের কোন বৈধ কর্মচারীও ছিল না। হাসপাতালের ডোমের ভাগ্নে হিসেবে সে কাজ করত সেখানে। মর্গের চাবি থাকত তার কাছে, থাকতও সেখানেই। মর্গে আসা মৃতদেহগুলো গ্রহণ করত সে, ময়নাতদন্তের সময় সাহায্য করত চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের এবং ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝিয়ে দিত স্বজনদের কাছে। আঘাতবিহীন লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ প্রতিটি মরদেহে হাই ভেজাইনাল সোয়াব বা শুক্রাণুর উপস্থিতির প্রমাণ পায়, যেগুলো একই ব্যক্তির। এরই সূত্র ধরে গ্রেফতার হয় বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন উক্ত ডোম। এ ধরনের যৌন বিকৃতিকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে নেক্রোফিলিয়া। গ্রেফতারের পর উক্ত ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছে। সিআইডি বলেছে, উক্ত ব্যক্তি যে জঘন্য অপরাধ করেছে তার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। অতঃপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে দেশের সব মর্গে। কেননা, মর্গগুলো অরক্ষিত, অনিরাপদ। দেশে ময়নাতদন্ত নিয়ে বিতর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও কিছু কম নেই। সর্বোপরি ১৮৭১ সালের সেই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আইন দিয়েই চলছে ময়নাতদন্তের কাজ। ময়নাতদন্তের নামে দেশে চলছে চরম অরাজকতা এবং দায়িত্বহীনতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রী-ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত চিকিৎসক ব্যতিরেকে প্রশিক্ষণবিহীন লোকজন দিয়ে, সমাজে অদ্যাবধি অস্পৃশ্য-অশুচি হিসেবে বিবেচিত ডোম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের দ্বারা। ফলে প্রায়ই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে যথার্থ সত্যের-তথ্যের প্রতিফলন ঘটছে না। এতে চরম বিঘ্ন ঘটে থাকে ন্যায়বিচারে আর বিচারবঞ্চিত থেকে যায় ভিকটিম ও পরিবার। ত্রুটিপূর্ণ এবং বিতর্কিত ময়নাতদন্ত নিয়ে ইতোপূর্বে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। ২০১৫ সালের ৩ জুন ফরিদপুর জেলা জজ আদালতের একটি অনুষ্ঠানে মামলার ক্ষেত্রে ময়নাতদন্তের গুরুত্ব প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন-৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগই ত্রুটিপূর্ণ। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যা।’ দেশের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং যখন এই কথা বলেন, তখন আশঙ্কা জাগে বৈকি। প্রায় শতভাগ ময়নাতদন্ত প্রদিবেদন যদি ভুল বা ভুয়া বিবেচিত হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ তথা বিচারপ্রার্থীর আস্থার জায়গাটা থাকে কোথায়? অথচ এর ওপরই এক বা একাধিক ব্যক্তির শাস্তি অথবা ক্ষমার বিষয়টি নির্ভরশীল ওতপ্রোতভাবে। এর পাশাপাশি রয়েছে বিকৃত রুচির ব্যক্তিদের অপকর্মের ঘটনা। বর্তমানে দেশের ৩০টি জেলায় মেডিক্যাল কলেজ আছে। সেসব স্থানে ফরেনসিক বিভাগ থাকলেও ময়নাতদন্তের কাজ হয় না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অবস্থা সহজই অনুমেয়। বিলেতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রীধারীরা মরচুয়ারি এ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডোমের কাজ করে থাকেন। আর বাংলাদেশে ময়নাতদন্তের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও কাজটি করে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত ডাক্তার অথবা তাদের পক্ষে ডোম সম্প্রদায়ের লোকজন। এই দুরবস্থার জরুরী অবসান অবশ্যই বাঞ্ছনীয়।
×