ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণময় বাদলের চিরবিদায়...

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ২৫ নভেম্বর ২০২০

বর্ণময় বাদলের চিরবিদায়...

খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে দেশের ফুটবলে অনেক বড় অবদান রেখেছেন বাদল কুমার রায়। নিপাট এই ভদ্রলোক ২২ নবেম্বর অনেকটা অভিমান করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। জীবনের খেলাঘর থেকে কিংবদন্তি এই ফুটবলারের চিরবিদায়ের পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে চলছে শোকের মাতম। ১৯৮২ সালে এশিয়াডে ইসা বাকের-আলী বাকেরের দেশ শক্তিশালী মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রথম জয় পেয়েছিল বাদল রায়ের গোলে। ১৯৮৭ সালে মোহামেডানের লীগ শিরোপা জয়ে আবাহনীর বিরুদ্ধে দুর্দান্ত গোল করে জিতিয়েছিলেন দলকে। ১৯৯৯ সালে সাফ গেমস ফুটবলে বাংলাদেশের স্বর্ণ জয়ে কর্মকর্তা হিসেবে রেখেছেন বড় ভূমিকা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) দুই দফায় প্রায় ১৬-১৭ বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মোহামেডান ক্লাবের জন্যও তার অবদান স্মরণীয়। মোহামেডান ছিল তার হৃদয়েরই অংশ। তিনি সব সময়ই নিজেকে বির্তকের উর্ধে রেখেই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৮২ সালে সালাম মুর্শেদী লীগে ২৭ গোলের যে রেকর্ড গড়েন তাতে সবচেয়ে বড় অবদান প্লেমেকার বাদল রায়ের। ওই বছর ছিল বাদলের গোল্ডেন ইয়ার। নিজেও ১৬ গোল করে মোহামেডানের সাফল্যে বড় অবদান রেখেছিলেন। বিগত বছরগুলোতে বাফুফের নানা অনিয়মের বিষয়ে কথা বলে তিনি অনেকের বিরাগভাজন হন। ২০১৭ সালে তিনি যে স্টোকে আক্রান্ত হন, তার পেছনে এটিকে দায়ী করা হয়। যাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফুটবল উন্নয়নে কাজ করেছেন, তাদের অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝেছেন বা বাফুফেতে ক্ষমতার লোভে তাঁকে এড়িয়ে চলেছেন। এটিই শেষ জীবনে বাদল রায়ের সবচেয়ে বড় কষ্ট। সেই অভিমান বা মন-কষ্ট নিয়েই পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন তিনি। বাদল রায়ের বর্ণাঢ্য ক্রীড়া জীবন এখন ইতিহাস। দীর্ঘ রোগভোগের পর দুনিয়ার মায়াজাল ত্যাগ করেছেন তিনি। বাদল রায় গত ১৩ আগস্ট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় থেকে চিকিৎসা করে করোনামুক্ত হন। ১৯ নবেম্বর ফের অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে আসগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তাররা তাকে দ্রুত আইসিইউতে নিয়ে যান। প্রসঙ্গত ২০১৭ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে বাদল রায়ের জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। দেশে চিকিৎসা নেয়ার পর অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাদল রায়কে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিলেন। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেন তিনি। বাদল রায়ের বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারে মোহামেডানের জার্সিতে খেলেছেন ১২ বছর। বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন পাঁচ বছর। দেশের ফুটবল অঙ্গনে তিনি মোহামেডানের বাদল রায় হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু একের পর এক রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাদল রায়। ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বাদল রায়। বিশেষ করে প্রিয় খেলা ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন নিজেকে। তিনবার তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি। এর আগে সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বাফুফের নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছিলেন বাদল রায়। কিন্তু অসুস্থতার কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তবে জীবদ্দশায় ফুটবলের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার ছিলেন বাদল। ক্যাসিনো কাণ্ডের পর দেশের ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ক্লাব পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সালে মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন বাদল রায়। ১৯৮৬ সালে মোহামেডানের লীগ শিরোপা পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বাদল রায়। মোহামেডানের ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন সাবেক এই তারকা ফুটবলার। এই সাবেক তারকা ফুটবলারের মৃত্যুর খবর চাউর হওয়ার পর শোকের ছায়া নেমে আসে ক্রীড়াঙ্গনে। ক্লাব, ক্রীড়া ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি দেশের ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেন বাদল রায়ের মৃত্যুতে। এক শোকবার্তায় তিনি সাবেক তারকা ফুটবলারের আত্মার শান্তি কামনা করেন। ঢাকার ওয়ারির স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তবে তার জন্মস্থান হচ্ছে কুমিল্লা। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন বাদল রায়। ২৩ নবেম্বর মতিঝিলের মোহামেডান ক্লাব প্রাঙ্গণে এবং বেলা ১২টায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বাদল রায়ের মরদেহ নেয়া হয় ক্রীড়াঙ্গনের মানুষের শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সাবেক তারকা ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা থেকে শুরু করে এই প্রজন্মের ফুটবলাররা মোহামেডান ক্লাবে যান শেষবারের মতো বাদল রায়কে দেখতে। ক্লাবের বর্তমান ফুটবলারা বিদেশী কোচের নেতৃত্বে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সদ্যপ্রয়াত জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার বাদল রায় ফুটবল ও ক্রীড়াঙ্গনকে ঐতিহ্যের ধারায় ফেরানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। শোকে মুহ্যমান কাতারে অবস্থানরত বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলও। নিজের ফেসবুক পেজে শোকপ্রকাশ করেছেন জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। কাতারেই সাবেক এই ফুটবলারের স্মরণে এক মিনিটের নীরবতা পালন করেছেন জামাল ভূঁইয়ারা। সেই ১৯৭৭ সাল থেকেই বাদলের সঙ্গে ছায়ার মতো জড়িয়ে ছিলেন আবদুল গাফফ্ার। তার কণ্ঠে উঠে এসেছে নানা ক্ষোভ ও বেদনা, ‘বাদল রায়কে যখন প্রথম হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি মারা গেলে তার মরদেহ যেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রাঙ্গণে না নেয়া হয়! এটাই ছিল তাঁর মনের ইচ্ছা। আমাকে এটা জানানোর আগে একই কথা তিনি তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। তখন তারাও (তার স্ত্রী) আমাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন গাফফ্ার ভাই, আপনার কাছে অনুরোধ রইল বাদলের কিছু হয়ে গেলে তাকে কখনই বাফুফে ভবনে নেবেন না। বাফুফের কেউ যেন বাদলের প্রতি কোনরকম শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না আসে। এই কথাটি আমার মনে অনেক দাগ কেটেছে।’ বাদল রায়ের হৃদয়ের গহীনে, প্রাণের স্পন্দনে যে নামটি ছিল লেখা, তা হলো মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। যে সাদা-কালো জার্সি পড়ে হয়েছিলেন বিকশিত, কুড়িয়েছেন দেশব্যাপী সম্মান-সাফল্য; সেই মোহামেডান ক্লাব প্রাঙ্গনেই এসে পৌঁছায় বাদলের নীরব-নিথর শবদেহ। তখন সৃষ্টি হয় শোকবিহবল-বেদনাবিধূর এক পরিবেশ। এই অবস্থায় বাদল মোহামেডানে ঢুকবেন, এই প্রত্যাশা করেননি কেউই। অনেকের চোখেই দেখা যায় অশ্রু। কারণ বছরের বাদলের সঙ্গে তাদের আছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা তাড়িত স্মৃতি। মোহামেডানের কিংবদন্তি এই ফুটবলারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর প্রিয় ক্লাব প্রাঙ্গণে তাঁকে আনা হলে শত শত ফুটবল-অনুরাগী, ভক্ত-সমর্থকরা ছুটে আসেন সেখানে। ছিলেন বাদলের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যারাও। বাদলের সন্তানরা তাদের মৃত বাবার প্রতি সবার অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে হতবিহবল। ক্লাব প্রাঙ্গণে সর্বস্তরের মানুষরা বাদলকে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে তাঁর অন্তিম শয়ানের আগে। বাদলের মেয়ে বৃষ্টি রায় আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমি বাবাকে হারিয়েছি ঠিকই। কিন্তু এখানে এসে উপলব্ধি করেছি সবাই আমার বাবাকে কতটা ভালবাসেন। অনেককেই পেয়েছি যারা আমাদের পরিবারের মাথার ওপর সবসময়ই ছায়া হয়ে থাকবেন। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আমার বাবা যদি কারোর মনে কষ্ট দিয়ে থকেন এবং কোন অন্যায় করে থাকেন, তাহলে সবাই তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন। আর বাবাকে সবসময় প্রার্থনায় রাখবেন। তাহলে বাবা যেখানেই থাকেন, ভাল থাকবেন।’ বাংলাদেশের আরেক কিংবদন্তি ফুটবলার কায়সার হামিদ। তিনিও বাদলের নিবিড় পরিচর্যায় তারকা ফুটবলার হয়েছেন মোহামেডানের হয়ে খেলে। তিনি বলেন, ‘খুবই শোকাহত। কারণ বাদলদার স্মৃতি ভুলবার মতো নয়। যিনি ফুটবলকে ভালবাসতেন, তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই! ফুটবলের উন্নয়ন নিয়ে সর্বক্ষণই তিনি ভাবতেন। বাংলাদেশের ফুটবলের দৈন্যদশা দেখে তিনি খুব কষ্ট পেতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল দেশের ফুটবলের হারানো গৌরব আবারও ফিরিয়ে আনা। এজন্য তিনি তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার প্রতি জোর দিয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ভাল ফুটবলার বের করার চেষ্টা করেছেন তিনি।’ ‘বাংলার ম্যারাডোনা’ খ্যাত সৈয়দ রুম্মন বিন ওয়ালী সাব্বিরও তারকাখ্যাতি পেয়েছেন মোহামেডানে খেলে। তিনি বলেন, ‘বাদলদার সবচেয়ে বড় গুণ- প্রথম থেকেই তিনি ফুটবল সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন, যেটা অনেকে শুরু করেন অনেক দেরিতে। খেলোয়াড়দের কিভাবে অনুপ্রাণিত করতে হয়, তিনি সেটা খুব করেই জানতেন। তিনি শুধু ভালো ফুটবলার ও সংগঠকই ছিলেন না, ছিলেন খুব ভাল একজন মানুষও।’
×