ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক

সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান আর নেই

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৫ নভেম্বর ২০২০

সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মুনীরুজ্জামান আর নেই। মঙ্গলবার সকাল ৭টা ২০ মিনিটে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। নোভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে খন্দকার মুনীরুজ্জামান মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ২১ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। কোভিড-১৯ থেকে মুক্ত হলেও পরবর্তীতে নানা শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। প্রখ্যাত এই সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিকের বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। রেখে গেছেন স্ত্রী এবং এক ছেলেকে। স্ত্রী ডাঃ রোকেয়া খাতুন স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক (অব.)। ছেলে ডাঃ ইশতিয়াক আলম সঞ্জু সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি) হিসেবে কর্মরত আছেন। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর তার করোনা পরীক্ষা করা হয়। টেস্টে পজিটিভ হওয়ার পর তিনি শান্তিনগরের নিজ বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৩১ অক্টোবর শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হলে তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি করোনা নেগেটিভ হন। কিন্তু অন্যান্য শারীরিক জটিলতর কারণে তিনি আর সুস্থ হননি। মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে খন্দকার মুনীরুজ্জামানের নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেয়ার পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, মুনীরুজ্জামান ছিলেন নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃত। তার মৃত্যু গণমাধ্যমের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। পৃথক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন যৌথ বিবৃতিতে খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক এবং দুঃখ প্রকাশ করেছেন। নেতৃবৃন্দ শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমাবেদনা জানান। এছাড়া খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যৃতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম। আরও শোক জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, কেন্দ্রীয় খেলাঘরের সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা পান্না কায়সার প্রমুখ। সাংগঠনিকভাবে শোক জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি, বিএমএ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)। দুপুরে জানাজার আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, দৈনিক সংবাদের সম্পাদক আলতামাশ কবির, মরহুমের বড় ভাই খন্দকার রফিকুজ্জামান, সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজাম সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে জানাজায় সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক ও সংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। জানাজা শেষে একটি কাচ বেষ্টনী ফ্রিজিং এ্যাম্পুলেন্সে রাখা মরহুমের মারদেহের সামনে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি), প্রেস কাউন্সিল, ভারতীয় হাই কমিশন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেসক্লাব, সম্পাদক পরিষদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, সংবাদ পরিবার, উদীচী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি। খন্দকার মুনীরুজ্জামান ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ডন স্কুলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। সেখান থেকে মুসলিম বয়েজ স্কুলে পড়েছেন দুবছর। এরপর ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট, জগন্নাথ কলেজ থেকে সয়েল সায়েন্সে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে এমএ ভর্তি হয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেও নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়া হয়নি। মুনীরুজ্জামান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় ১৯৬৩ সালের নবেম্বর মাসে জগন্নাথ কলেজ ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে গোপন কর্মী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ’৭০-এর দিকে শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন। একাত্তরে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির সম্মিলিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচে আসামের তেজপুরে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। আগরতলায় পার্টির একটি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ‘ইনচার্জ’ ছিলেন। তিনি যুদ্ধকালীন পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর মুনীরুজ্জামান একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি ঢাকা মহানগর কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র সাপ্তাহিক একতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে ’৯০-এর দশকে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে যোগদান করেন। পরে রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী কলাম লেখক হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। ১৯৯৬ সালের ১৪ মে তিনি দৈনিক সংবাদে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন এবং আমৃত্যু এই দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৯ সালে মুনীরুজ্জামান প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। তিনি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও মুনীরুজ্জামান কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, চিত্র সমালোচনা এবং নিয়মিত কলাম লিখতেন। তিনি একাধারে কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকও ছিলেন। ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। এছাড়া টেলিভিশন টক শো’রও পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি।
×