ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তনন পেরেছে আমরা পারিনি

প্রকাশিত: ২২:০৪, ২৫ নভেম্বর ২০২০

তনন পেরেছে আমরা পারিনি

‘রক্তের দাগ শুকায় নাই’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথাটি ধার করে বলি। লালমনিরহাটে কোরান শরীফ অবমাননার দোহাই তুলে শহীদুন্নবী জুয়েল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক, নিরীহ এক ভাইকে হারানোর খত আর রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই খবর এল আরও এক ভয়াবহ মৃত্যুর, অশনি হত্যাকাণ্ডের। সেই খবরের প্রসঙ্গ টানার আগে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আমরা এসেছি’ কবিতা থেকে কয়েকটি স্তবক উদ্বৃত্ত করতে চাই- আজকে হালকা হাওয়ায় উরুক একক চিল/জলতরঙ্গে আমরা কিন্তু ঢেউ ফেনিল। উধাত্ত আলোর নিচে সমারোহ/ মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ। ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ/ কী গতিশীল! সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল ॥ কবি সুকান্ত যেই বয়সে কবিতার এই চরণ লিখেছিলেন, তার কাছাকাছি বয়সে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এক তরুণ কবি মৃত্যুর মুখোমুখি হলেন। সাহসী তরুণ ও প্রত্যয়ী কবির নাম সৈয়দ মুনাব্বির আহমেদ তনন। তনন ছিলেন একক চিল। যে চিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাকী রুখে দাঁড়িয়েছিল, সমাজ ও জীবনের ত্রাস সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তুলেছিল ফেনিল ঢেউ। উ?াত্ত হয়ে যাওয়া আলোর নিচে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদহীন সময় ও জনপদে সমারোহে করেছিল প্রাণের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ গানের, এই বিদ্রোহ কবিতা ও প্রাণের, এই বিদ্রোহ মানুষের মানুষ হিসেবে অস্তিত্বকে জানান দেয়ার। তনন ছিলেন এমন এক তরুণ, এমন এক কবি, যার ভীরুর বেশে ফিরে তাকাবার ফুসরৎ নেই। তিনি যে সাহসী, তিনি কবি, তিনি সময়কে বোঝেন, সময়কে উদযাপন করেন সত্য ও সুন্দরের পক্ষে জীবন এবং প্রকাশের সকাশে। সূর্যের কাছ থেকে উজ্বলনের এখতিয়ার নিয়ে চলা সৈয়দ মুনাব্বির আহমেদ তননের ভুবনটা কেমন ছিল? জেনে নেয়া যাক। তনন ছিলেন ‘নিমগ্ন পাঠক’ নামের একটি ছোট কাগজের সম্পাদক, সংস্কৃতিকর্মী, প্রতিভাবান ছাত্রনেতা। কিন্তু তিনি ছিলেন শয়নে, স্বপনে, নিদ্রায়, জাগরণে এক কবি। তিনি সূর্যের কাছ থেকে আগুনের অধিকার নিয়েছিলেন, দেখিয়েছিলেন কবিদেরও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। করেছিলেনও তাই। আর এই প্রতিবাদই তার জীবনে বিপদ ডেকে আনল। একটি সরকারী খালে কতিপয় স্বার্থনেষী মহল মাছ ধরার স্বার্থে বাঁধ নির্মাণ করায় জনদুর্ভোগ বাড়ছিল। তনন করেছিলেন প্রতিবাদ। এ ঘটনা ঘটে ৯ নবেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের আলিশ গ্রামে। তনন পড়তেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, স্নাতকোত্তর পার্যায়ে। তিনি ছিলেন সৃজন সাহিত্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, পিতৃছায়া প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী। একুশে সৃজন ও দশ দিগন্ত সাপ্তাহিক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক। এ রকম একজন প্রতিভাবান তরুণ নিজ গ্রামে প্রকাশ্যে দশ পনেরোজন দুর্বৃত্তের হাতে প্রাণ দিলেন। আমরা লালমনিরহাটের নির্বিরোধ শহীদুন্নবীকে মারা, কাটা, আগুনে পোড়া থেকে রক্ষা করতে পারলাম না। এই দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিবাদী তরুণ কবি তননকেও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে পারলাম না বাঁচাতে । টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়ায় আমরা তাহলে কাকে রক্ষা করব? উল্লিখিত এই দুই ঘটনাই শুরু বা শেষ, এ কথা বলা যাবে না। এ রকম ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক। খবরের কাগজের আর্কাইভ ঘাটলে এ রকম বিস্তর খবরের সমারোহ পাওয়া যাবে। কথায় আছে নগর পোড়ালে দেবালয় যেমন এড়ায় না, তেমনি মসজিদও রেহাই পায় না। এই ঘুণেধরা পচে যাওয়া লুটপাট জবরদখলপ্রবণ বিদ্যমান সমাজে শহীদুন্নবী জুয়েল বা সৈয়দ মুনাব্বির আহমেদ তননের পালাই শেষ নয়। কেবল অপেক্ষার পালা কবে কখন কার কপালে কোন দিক দিয়ে দুর্ভোগ নেমে আসে। উদাহরণ আরও আছে পুলিশ কর্মকর্তা আনিস আকরাম মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে পিটুনিতে প্রাণ দিলেন। পুলিশের হেফাজতে জনতার প্রাণ যাবে, হাসপাতালে চিকিৎসার নামে পিটুনি চলবে- প্রকাশ্যে অন্দরে এসব নানা অঘটনের লাগাম টানার ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ায় যা হওয়ার তাই ঘটে চলেছে। আমরা কি এ রকম ঘটতেই দিতে থাকব? অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না। আবার নির্বিরোধ ভাল মানুষও থাকা যাবে না। তাহলে সবাই কি দুর্বৃত্ত হয়ে যাব? আমরা কি মোটাদাগে দুর্বৃত্ত এক সমাজ নির্মাণ করব সকলে মিলে? নাকি দুর্বৃত্তায়ন ঠেকাব তননের দেখানো পথে? এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। তনন মরিয়া প্রমাণ করেছে, সে পেরেছে। আমরা বেঁচে থাকারা পারিনি। আমরা বেঁচে আছি মরার মতন, বেঁচে থাকার ভান করে। বিশ্বাস না হয় কবিদেরই বলি, মস্তবড় কবিদেরই বলি, আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখুন আর নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখুন আদৌ বেঁচে আছেন তো? না কি জীবনে মৃতের উর্দি পরে সুবিধাভোগী থেকে গেলেন নানা সরকারের আমলে। সে যাই হোক, তনন পেরেছে। আমরা পারি নাই। তননের কোন ভীরু মোহ ছিল না, আমাদের ছিল। তাই সে তুলেছে ঢেউ প্রতিবাদের, জীবনের সত্যের কবিতার ও তারুণ্যের। তনন জীবন দিয়ে যে কবিতা রচনা করে গেল, যে সত্যের আগুন জ্বেলে গেল, এই আগুন, এই সত্য বড় ভারি, আমরা কি তা বইতে পারি? সইতে পারি? তননের লেখা ‘জন্মভূমি’ নামক কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে লেখাটি শেষ করছি। ‘আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়/আকাশ বাতাস জানবে সাগর নদী ছাড়িয়ে যাবে দিগি¦দিক বাংলার অলিগলি/সাক্ষী থাকবে মুক্ত পাখি সবুজ প্রকৃতি/যেখানে লুটিয়ে আছে তাজা প্রাণের স্মৃতি। লেখক : সাহিত্যকর্মী
×