ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

শীতে বেড়ানো এবং পাহাড়ের সুখদুঃখ

প্রকাশিত: ২২:০৩, ২৫ নভেম্বর ২০২০

শীতে বেড়ানো এবং পাহাড়ের সুখদুঃখ

সাজেকের প্রকৃতি সমৃদ্ধ হলেও সাধারণ মানুষের অবস্থা প্রায় দীনহীন। পর্যটন শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ হলে একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে পারত এখানকার আর্থিক জীবন। স্থানীয় অধিবাসীরা ‘মিজো’ নৃ-গোষ্ঠীর যারা মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করেন তাদের প্রায় সবার রয়েছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক তারা। সাজেকে কটেজ বা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করছেন, আবার ভারতের মিজোরামেও তাদের ব্যবসা রয়েছে। ছেলেমেয়েরা মিজোরামে ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে। তারা ইংরেজীতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বাংলা বলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার ইউনিয়ন হলেও ঢাকা থেকে সাজেক যাওয়ার সোজা পথ খাগড়াছড়ি হয়ে যাওয়া। খাগড়াছড়ি জেলার উত্তর-পুবে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা দুটি গ্রাম রুই-লুই এবং কংলাকপাড়া নিয়ে সাজেক ইউনিয়ন। যেতে-আসতে সেনাসদস্যদের কড়া নজরদারি পেরোতে হয়। ভ্রমণার্থীদের কয়েকটি গাড়ি সেনাবাহিনীর চেক পয়েন্টে জড়ো হলে সেনাসদস্যের গাড়ি কর্ডন করে সাজেকে পৌঁছে দেয়। যারা দার্জিলিং গেছেন সাজেক ভ্যালির আকাশে তাকালে তাদের স্মৃতি কড়া নাড়বে। দলবেঁধে মেঘ ছুটছে আকাশের এদিক থেকে ওদিক। ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে পাহাড়ী অরণ্য ছাপিয়ে লোকালয়ে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে মেঘের এমন রঙের খেলা মনে পড়িয়ে দেয় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন ছবি ‘কাঞ্চন জঙ্ঘা’র কথা। হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম চূড়া কাঞ্চন জঙ্ঘার আলো-আঁধারীকে ক্যামেরায় তিনি যেভাবে খেলিয়েছেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তা আজও স্মরণীয়। কলকাতা থেকে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসা এক উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে শহুরে কৃত্রিমতা ও সঙ্কীর্ণতা যে কুয়াশাচ্ছন্নতা সৃষ্টি করেছে দার্জিলিংয়ের মেঘলা আকাশের পটভূমির সঙ্গে তা তিনি সমান্তরালভাবে মিলিয়ে ক্যামেরায় তুলে এনেছেন। মেঘলা প্রকৃতি যেন মেঘাচ্ছন্ন মনেরই প্রতীক। আবার মেঘ কেটে কাঞ্চন জঙ্ঘা ক্রমশ উজ্জ্বল হলে ঘটনার পরম্পরায় মানুষগুলোর মনও মুক্ত হয় সব সন্দেহ-সংশয়, ভীরুতা ও সঙ্কীর্ণতা থেকে। কেটে যায় গ্লানির কুয়াশা। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে তারা। সত্যি, প্রকৃতির অসীম ক্ষমতা রয়েছে দৈনন্দিনতার ক্লান্তি ঘুচিয়ে মনকে নতুন আলোর নির্যাসে ভরিয়ে দেয়ার। গাড়ি বলতে স্থানীয় ভাষায় ‘চান্দের গাড়ি’। পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে চমৎকার পিচের রাস্তা। বছর দুয়েক হলো চালু হয়েছে। অবশ্য রাস্তা হওয়ার আগেও দুর্গম পাহাড়ী পথ পেরিয়ে সাজেকের অপরূপ প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করেছে প্রকৃতিপ্রেমীরা। যাওয়া-আসার পথের দু’ধারে পাহাড়ী প্রকৃতিও অসাধারণ। কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্পের জলাধারে কর্ণফুলীসহ এর শাখা নদী চেঙ্গী, কাসালং, মাসালং ও মাইনী নামে যেসব নদীর উপত্যকা ডুবে গিয়েছিল সেসব নদীর মধ্যে যমজ কাসালং, মাসালংয়ের উৎপত্তি সম্ভবত এখানে। পাশাপাশি দুটি ধারা বয়ে গেছে দু’দিকে। উনিশ শ’ সাতান্ন সালে নির্মিত কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্পের জলাধার বা লেকে বিলীন হওয়া গ্রাম জনপদ ফসলী জমি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া ছিল পাহাড়ীদের ভূমি অধিকারের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। ব্রিটিশ আমল থেকে ভূমির স্থায়ী মালিকানা নিয়ে পাহাড়ীদের সঙ্গে নানা ধরনের ছলচাতুরী চলেছে। ব্রিটিশ আমলের আগে এদের ভূমি ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে অস্থায়ী ব্যবহারের অধিকার বণ্টন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আঠারো শ’ পঁয়ষট্টি সালের ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ফরেস্ট এ্যাক্ট ও পরের আরও কয়েকটি আইনের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সব জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বলে ঘোষণা করে এবং আঠারো শ’ পঁচাত্তর সালের মধ্যে একে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা জবংবৎাব ভড়ৎবংঃ এবং জেলা বনাঞ্চল বা উরংঃৎরপঃ ঋড়ৎবংঃ নামে দু’ভাগ করে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পাহাড়ীদের জীবনযাপনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যেমন জুম চাষ, ফলমূল চাষ, শিকার ইত্যাদি নিষিদ্ধ হয়। বসবাসের জন্য নির্ধারিত হয় জেলা বনাঞ্চল। তবে এখানে বসবাসের অনুমতি দিলেও এর ওপর পাহাড়ীদের মালিকানার আইনী অধিকার ছিল না। আইনের দৃষ্টিতে এ ছিল খাস জমি। যার অর্থ প্রশাসন চাইলে যে কোন সময় এ ভূমি কেড়ে নিতে পারে। অর্থাৎ জন্ম-জন্মান্তর ধরে বাস করে আসা নিজস্ব ভূমিতে পাহাড়ীরা হয়ে পড়ে অস্থায়ী বসবাসকারী। তবে বিশ শতকের শুরু থেকে পাহাড়ীদের জুম চাষ ছেড়ে লাঙ্গল দিয়ে চাষে উৎসাহিত করতে ভূমির ওপর ব্যক্তি ও যৌথ মালিকানা দেয়া শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। উনিশ শ’ সালে প্রবর্তিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধান’-এ বহিরাগত অপাহাড়ীদের নামেও ভূমি নিবন্ধন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এতে সমতল ভূমি থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যেই এ আইনের সংশোধনী আনা হয়, যাতে অপাহাড়ীদের জমি লিজ দেয়া বা হস্তান্তরের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। উনিশ শ’ একাত্তরের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকারের ‘চট্টগ্রাম বিধান’-এর চৌত্রিশ নম্বর ধারায় ব্যাপক সংশোধনী আনা এবং উনিশ শ’ ঊনআশি সালে বাংলাদেশ সরকারের ওই একই ধারার শর্তগুলো শিথিল করে দেয়ায় অপাহাড়ীদের পাহাড়ে প্রবেশ এবং পাহাড়ী জমির বন্দোবস্ত পাওয়ার পথ শুধু খুলেই গেল না, তা হয়ে যায় প্রায় অবাধ। আশির দশকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অপাহাড়ীদের পাহাড়ে পাঠানোর দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়। এই বাঙালী অভিবাসীদের পাহাড়ে উৎসাহিত করতে পাহাড়ে জমি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু লাখ লাখ অভিবাসীকে দেয়ার মতো জমি পাহাড়ে ছিল না। সুতরাং হাত পড়ল পাহাড়ীদের ব্যক্তি ও যৌথ মালিকানার জমিতে। কোন ধরনের ভূমি সংস্কার ছাড়া এগুলো জোর করে বাঙালী অভিবাসীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এতে ভূমিহীন হয় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ। এই জাতিগত নিপীড়ন এখনও চলছে। খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা কমতে কমতে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। ওদের সঙ্গে কথা বললে টের পাওয়া যায় ওদের ভেতরের চাপা কান্না। যদিও সরকারীভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের মূল স্রোতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে। এখানে সামাজিক-রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে পক্ষ দুটি- পাহাড়ী বনাম বাঙালী। নানা অজুহাতে বাঙালীরা পাহাড়ীদের উত্ত্যক্ত করে। দীর্ঘ বঞ্চনা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের পর উনিশ শ’ সাতানব্বই সালে যে ‘শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় তাতে পাহাড়ীদের জায়গা অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করে তাদের ফিরিয়ে দেয়ার কথা ছিল। বলা হয়েছিল ভূমি কমিশন গঠন করে বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। তা গঠন করাও হয়েছিল। ভূমি কমিশন আইনও প্রণয়ন হয়েছে, কিন্তু পাহাড়ীদের জমি পাহাড়ীদের কাছে আর ফিরে যায়নি।
×