ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নদী দূষণ রোধে নতুন আদালতের প্রয়োজন নেই পরিবেশ দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালতই যথেষ্ট

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কার্যকর করতে আইন কমিশনের সুপারিশ

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৪ নভেম্বর ২০২০

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কার্যকর করতে আইন কমিশনের সুপারিশ

বিকাশ দত্ত ॥ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান অবস্থাকে আরও কার্যকর করার লক্ষ্যে আর্থিক স্বাধীনতাসহ তিন ধরনের সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। অন্য দুটি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সদস্যসংখ্যা বাড়ানো এবং কমিশনের সকল সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো। আইন কমিশনের মতে, নদী দূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নতুন কোন আদালত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান পরিবেশ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। হাইকোর্টের রায়ে কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আইনগত অভিভাবকের ধারণাটি নাবালকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নদী কমিশনকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রূপান্তর করা হলে ২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মের বিশৃঙ্খলা এবং মারাত্মক জাটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। খসড়া আইনে এই সংক্রান্ত নতুন যত বিধান যুক্ত হয়েছে সবই অপ্রয়োজনীয় বিধায় বাদ দেয়াই যুুক্তিযুক্ত ও সমীচীন। সম্প্রতি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ (খসড়া) প্রসঙ্গে আইন কমিশনের মতামত ও সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিশন যাচাই বাছাই করে ওই সুপারিশ পাঠিয়েছেন। কমিশনের অপর সদস্য হলেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। এটি আইন কমিশনের ১৫৫ তম সুপারিশ। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ‘জাতীয় নদী রক্ষা আইন-২০২০’ এর খসড়া পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিশীলন, পরিমার্জন ও সমৃদ্ধকরণের জন্য আইন কমিশনকে অনুরোধ করে। খসড়া আইন প্রস্তুতের পটভূমিতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে তড়িঘড়ি করে আইনটি তৈরি করার কারণে আইনের ১২ ধারায় কমিশনকে কেবলমাত্র সরকারের নিকট পরামর্শ ও সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। অনুরূপ প্রায়োগিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। ফলে রিট মামলা নং ১৩৯৮৯/২০১৬’র রায়ে ৩ নং আদেশে হাইকোর্ট বিভাগ দেশের সকল নদ-নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের নিমিত্ত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করাসহ ৭, ৯ নং আদেশে কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণতকরণের জন্য সরকারকে অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশসহ নদী দখল ও দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে এর কঠিন সাজা ও বড় আকারের জরিমানা নির্ধারণ করে কমিশন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। হাইকোর্ট তার রায়ের ৩ নং আদেশে বলেছে, নদী রক্ষা কমিশনকে তুরাগ নদীসহ দেশের সকল নদ-নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করা হলো। আদেশ ৭ এ নদী দখল এবং দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে এর কঠিন সাজা এবং বড় আকারে জারিমানা নির্ধারণ করা। আদেশ ৯ এ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে একটি কার্যকর, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ অনতিবিলম্বে গ্রহণ করার নির্দেশ প্রদান করা হলো। উপরোক্ত পটভূমির আলোকে বর্তমান জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে নিশাথ জুট মিলস লিমিটেড বনাম হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপীল নম্বর ৩০৩৯/২০১৯) মামলায় আপীল বিভাগ কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের ৪,৭,১০,১১,১২,১৩,১৫,১৬ এবং ১৭ নং নির্দেশনা সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ প্রদান রায়টি পরিমার্জনা করা হয়েছে। আইন কমিশন মনে করে প্রস্তাবিত আইনের প্রারম্ভিক বা প্রস্তাবনায় ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং ৩৫০৩ /২০০৯ এবং ১৩৯৮৯/২০১৬ এর রায়ে প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট আদেশ, নির্দেশ ও নির্দেশনা ও আলোকে এবং বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ক, ২১, ৩১ ও ৩২ অনুসরণে আইনের অধিকতর সংশোধন উল্লেখ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আপীল বিভাগ বিষয়গুলো পরিমার্জনা করেছে বিধায় খসড়ার প্রস্তাবনায় এগুলো সংযোজনের কোন সুযোগ নেই। তাই প্রস্তাবনা পরিবর্তনের কোন প্রয়োজনই নেই। এ ছাড়া ১৮টি প্রতিষ্ঠানও তিনটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নদী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। অতিসম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ পানি সম্পদ অধিদফতর নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বিদ্যমান নদী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৩টি মন্ত্রণালয় ও ১৮টি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রূপান্তরিত করা হলে উপযুক্ত ২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মের বিশৃঙ্খলা এবং মারাত্মক জাটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। ইতোমধ্যে আপীল বিভাগ এই বিষয়গুলো পরিমার্জনা করেছে বিধায় খসড়ার প্রস্তাবনায় এগুলো সংযোজনের কোন সুযোগ নেই। তাই প্রস্তাবনা পরিবর্তনের কোন প্রয়োজনই নেই। আইন কমিশন তার সুপারিশে বলেছে, হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগের রায় দুটির আলোকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রেরিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন খসড়া আইনটি পর্ক্ষীা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। রায় পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, হাইকোর্ট বিভাগ আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত যেসব নির্দেশনা সরকারের প্রতি জারি করেছে সেগুলো আপীল বিভাগ পরিমার্জনা করেছে। কোন প্রকার আইন প্রণয়নে আদালত সরকারকে নির্দেশ দিতে পারে না সিদ্ধান্ত প্রদান করে আপীল বিভাগ উল্লেখ করেছেÑ আদালত কেবল আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে মতামত বা পরামর্শ দিতে পারে। আপীল বিভাগের এই সুস্পষ্ট পরিমার্জনাকৃত (সড়ফরভরবফ) রায়ের পরে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক আইন প্রণয়ন সংক্রান্তে সরকারের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশনা বজায় থাকল না, বরং তা পরিণত হলো মতামতে বা পরামর্শ হিসেবে। সুতরাং হাইকোর্ট বিভাগের এই নির্দেশনাসমূহ মতামত বা পরামর্শ বিবেচনায় জাতীয় নদী কমিশন কর্তৃক খসড়াকৃত আইনটি পর্যালোচনা করতে হবে। পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সৃষ্টির পটভূমি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ২০০৯ সালে হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় সরকারের প্রতি হাইকোর্ট বিভাগ নিম্নোক্ত আহ্বান জানায়। (ক) বাংলাদেশ সকল নদী দখল ও দূষণমুক্তকরণ ,নদীগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ,উন্নতি সাধন ও নৌপরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহযোগে একটি ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠন। (খ) উক্ত নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশ অনুসারে বাংলাদেশের সকল নদীর উন্নতি সাধনের জন্য একটি স্বল্পকালীন এবং দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা গস্খহণ। (গ) বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর নাব্য আগামী ৫ বছরের মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় এবং কার্যকর তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ। (বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছিল)। আইন কমিশন বলেছে, হাইকোর্ট বিভাগের উপরোক্ত আহ্বানের ‘ক’ এবং ‘খ’ দফার মর্ম অনুসারে একটি সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যে সুপারিশ অনুসারে সরকার অন্য কোন সংস্থা নয় বাংলাদেশের সকল নদীর উন্নতি সাধনের পদক্ষেপ নেবে। সে মতে ২০১৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। উক্ত আইনের ৩(২) ধারায় কমিশনকে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থার পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এই আইনের ১২ ধারায় কমিশনের কার্যাবলীতে সর্বমোট ১৩টি বিষয় সুনির্দিষ্ট করা আছে। ১৩টি বিষয়ে প্রকৃত কার্যক্রম পরিচালনায় বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সক্রিয় আছে। পাশাপাশি নদী ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে বর্তমানে তিনটি মন্ত্রণালয় নিয়োজিত আছে। মন্ত্রণালয় তিনটি হলোÑ ভূমি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ১৬ টি সংস্থা ও দুটি ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান কর্মরত আছে। সংস্থাগুলো : বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউ, যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর, পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, পায়রা কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ, মেরিন একাডেমি, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট। ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান দুটিÑ ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ও সিজিআই এস। এই খসড়া আইনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদ্যমান নদী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ৩টি মন্ত্রণালয় ও অন্য ১৮টি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রূপান্তরিত করা হলে উপযুক্ত ২১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মের বিশৃঙ্খলা এবং মারাত্মক জাটিলতা সৃষ্টির আশঙঙ্কা আছে। উল্লেখ্য, এ রায়ের পরে সরকার নদী রক্ষা কমিশন করেছে। হাইকোর্ট পরে আরেকটি রায় প্রদান করে। পরবর্তীতে আপীল বিভাগ রায় প্রদান করেছে। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে (রিট পিটিশন নং ১৩৯৮৯/২০১৬) কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘আইনগত অভিভাবক’ ধারণাটি নাবালকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে যে, নদী সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয় ও ১৮টি প্রতিষ্ঠান সক্রিয় আছে। এই অবস্থায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক হিসেবে স্থান দেয়া হলেও বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে কার্যকর হলে সংবিধানের আওতায় স্থাপিত তিনটি মন্ত্রণালয় ও অন্য ১৮টি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনাতিরিক্ত হয়ে পড়বে। এবং সরকারের নদী ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রমের মারাত্মক জটিলতার আশঙ্কা দেখা দেবে। বিশেষত হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে নদী রক্ষা কমিশন সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল যার মূল বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। উল্লেখ্য, ওই রায়ে কমিশনকে সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে। যা মূলত নদী সংরক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যা সম্বন্ধে সরকারের চোখ ও কান হিসেবে ভাবা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
×