ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবিদ হোসেন-শিল্প ভুবনে নিভৃতচারী সাধক

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৪ নভেম্বর ২০২০

আবিদ হোসেন-শিল্প ভুবনে নিভৃতচারী সাধক

রুমেল খান ॥ জীবন স্পর্শ করেই শিল্পের উদ্ভব। শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে তাই মানুষের আবর্তকালের সংগ্রাম ও সম্প্রীতির কত কথা উঠে আসে। চিত্রের সঙ্গে শব্দ ও কাব্যের সমন্বিত শিল্পপ্রয়াসও শিল্পকলায় বহুভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। এমনটি ঘটেছে ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও। বিংশ শতাব্দীর আগে ভাস্কর্যকে বাস্তবের প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্প হিসেবে ধরা হতো, যখন মানুষের রূপ, প্রাণী, নির্জীব বস্তু ইত্যাদির প্রতিমামূলক ভাস্কর্য নির্মাণের প্রচলন ছিল। বিংশ শতক থেকে বাস্তবের প্রতিনিধি নয়, এমন সব বিমূর্ত ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু হয়। সমসাময়িক যুগে এসে ভাস্কর্যের সংজ্ঞা অবশ্য বদলে গেছে। বর্তমানে অভিব্যক্তি প্রকাশকারী ত্রিমাত্রিক যে কোন শিল্পকর্মই ভাস্কর্য। ব্যতিক্রমী এক শিল্পী ভাস্কর আবিদ হোসেন। বয়স ৫৪ বছর। দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে তিনি শিল্পচর্চা করছেন। তার এমনও শিল্পকর্ম রয়েছে, যার একেকটি বিক্রি হয় লাখ টাকা অথবা তারও বেশি দামে। অথচ আশ্চর্যজনক সত্যি যে, আজ পর্যন্ত তিনি নিজের সৃষ্ট শিল্পকর্ম নিয়ে একবারও প্রদর্শনী করেননি! এমনকি কোন প্রচার মাধ্যমের শরণাপন্ন হননি। নিভৃতচারী, অন্তর্মুখী, লাজুক ও প্রচারবিমুখ এই শিল্পী অন্যদের চেয়ে একদমই আলাদা। শিল্পী আবিদ হোসেনের তৈরি ‘ভাস্কর-চিত্র’ (তার ভাষায় ‘হ্যান্ড মেইড’) কেন অন্য শিল্পীদের চেয়ে আলাদা ও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল, তার ব্যাখ্যা জনকণ্ঠকে তিনি দিয়েছেন এভাবে- ‘ভাস্কর্য-শিল্পীদের কাজগুলো হয় দাঁড় করানো, বড় আকারে, উন্মুক্ত স্থানে এবং এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসানো। আর আমার কাজটি হয় বিভিন্ন আকারের বোর্ডের (এটাকে ক্যানভাস মনে করতে পারেন) ওপর, দেয়ালে আটকানো অবস্থায়, ইনডোরে, এটা স্থানান্তরও করা যায়। তিনি বলেন, আমার ছবি দেখলে সবাই প্রথমে ধরে নেবেন ছবিটা নিশ্চয়ই রং-তুলি দিয়ে ক্যানভাসে এঁকেছি। আসলে তা নয়। ছবিটা আমি মোটেও হাতে আঁকিনি, এটি আমি হাতে বানিয়েছি! কার্টার, চিকন সুচ ইত্যাদি উপাদান আমি ব্যবহার করি ছবি বানাতে। আমার জানা মতে, এদেশে কারও হাতে আমি এ ধরনের কাজ দেখিনি। বিদেশে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে আমি ছাড়া কেউ নেই। এক্ষেত্রে আমিই প্রথম।’ ১৯৯৮ সালে নিজেই গবেষণা করে ‘মিক্সমিডিয়া’ (এক ধরনের উপাদান) তৈরি করেন আবিদ। নতুন ও স্থায়ী ঠিকানায় এসে আবিদের মাথায় আবারও তার শিল্পচর্চার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেই শিল্পকর্মের নাম ‘ভাস্কর্য-চিত্র’। আবিদের ভাস্কর্যচিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হলোÑ সেটি নির্মাণ করার দু’দিনের মধ্যেই জমে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়! এ ধরনের ‘ছবি’ বা ভাস্কর্য-চিত্র মাটিতে পড়লে, হাত দিয়ে আঘাত করলে, মোচড়ালে, গরমে বা ঠাণ্ডায় থাকলে, পানিতে ভিজলে-এমনকি আগুনে পুড়লেও এটা নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং কমপক্ষে ৫০ বছর বা তারচেয়েও বেশি সময় ধরে এর স্থায়িত্ব থাকবে। তবে এতটা দীর্ঘ সময়ে ছবি হয়ত বিকৃত হয়ে যাবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমার ছবিগুলো এন্টি ডাস্ট করা। ফলে এতে ধুলো আটকাবে না। ভাস্করচিত্র তৈরির যে ‘গুপ্তবিদ্যা’ আয়ত্ত করেছেন আবিদ, সেটা ভবিষ্যতে কাউকে শিখিয়ে যেতে পারলে খুবই খুশি হবেন তিনি। এ নিয়ে কোন পরিকল্পনা আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আছে। আমি এক সময় থাকব না। কিন্তু আমার ছবিগুলো থাকবে। সেই সঙ্গে ছবি তৈরির বিদ্যাটা জানার জন্যও কেউ থাকুক। আপাতত এই বিদ্যাটা শিখছে আমারই ছোট মেয়ে। এমনিতে তার ছবি আঁকার হাত খুব ভাল। অথচ তাকে এসব আমি শেখাইনি। এটা হয়ত তার রক্তেই রয়েছে। ভাস্করচিত্র তৈরির সময় সে আমাকে সবসময়ই সাহায্য করে। বলা যায় সে আমার সহকারী। এভাবেই সে বিদ্যাটা শিখছে।’ ভাস্করচিত্র তৈরির উপকরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আবিদের জবাব, ‘ম্যাটেরিয়ালসগুলো আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে প্লাস্টিক পাউডার, কর্ন ফ্লাওয়ার, আইকা, কাঠের ভূষি, কপার ইত্যাদি। এগুলো সঠিক পদ্ধতিতে ও বিশেষ পরিমাণে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। এখানে আলাদা কোন রংং নেই। তবে ছবি অনুযায়ী আলাদা রঙের প্রয়োজন হলে সেই উপাদানগুলো থেকেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় ‘একরামিন কালার’ থেকে প্রয়োজনীয় রংং বের করে নিই বিভিন্ন কেমিক্যালের মিশ্রণ ঘটিয়ে।’ শুরুতে কাজ নিখুঁত না হওয়াতে বিপাকেও পড়তে হয়েছে আবিদকে। রং ফেটে যেত। কেন এমন হয়, কিভাবে এটা নিখুঁত করা যায়, এ নিয়ে বছর চারেক কঠোর ওপর গবেষণা-পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। এক সময় তার গবেষণা শতভাগ সফল হয়েছে। গবেষণার সুফল তিনি পেয়েছেন পরবর্তী সময়ে। মালমসলাগুলো কিভাবে ও কতদিন ধরে সংরক্ষণ করতে হয়, এগুলো দিয়ে কিভাবে ও কতক্ষণ ধরে ভাস্করচিত্রের কাজ করতে হয়, এগুলোর সীমাবদ্ধতা কী কী ... সেগুলোও সবিস্তারে জানান আবিদ। ছবির ধরন অনুযায়ী একেকটি ছবি তৈরিতে একেক রকম অর্থব্যয় হয় আবিদের। একটি ছবিতে (ফ্রেমগুলো কেনেন, বোর্ডগুলো নিজেই তৈরি করেন) তার এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকার মতো। সেই ছবিটিই তার সবচেয়ে বড় আকারের ছবি। তাই সময়ও লেগেছে সবচেয়ে বেশি, ১০৭ দিন! ওজনও সবচেয়ে বেশি, ৩৫ কেজি। ৩ ফুট বাই ৬ ফুট এই ছবিটি তৈরি করতে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা মেধা-শ্রম দিতে হয়েছে তাকে। ছবিটির নাম ‘ওল্ড সিটি অব ঢাকা।’ এই ছবিতে ঢাকার প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যবাহী সব দর্শনীয় স্থান-স্থাপনা, মানুষের জীবনযাপনসহ অনেক কিছুই আছে। নয়নাভিরাম ভাস্করচিত্রটি দেখলে যে কেউই অবাক ও মুগ্ধ হতে বাধ্য। এমনিতে স্বাভাবিক আকারের ছবি বানাতে মাসখানেক লাগে আবিদের। সাধারণত রাতে কাজ করেন তিনি, আর দিনে ঘুমান। ঘুম থেকে উঠে গত ২২ বছরে আবিদ ৭৫টি ভাস্কর-চিত্র বানিয়েছেন। এ পর্যন্ত তার ভাস্করচিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে পৌনে চার লাখ টাকা। নতুন এ্যাপার্টমেন্টের যারা মালিক, তারাই মূলত এগুলোর ক্রেতা। ভাস্করচিত্রগুলো বিক্রি করেই দায়িত্ব শেষ করেন না আবিদ। সেগুলো কিভাবে যত্ন নিতে হবে, কিভাবে বাড়ি বা অফিসের দেয়ালে সেট করতে হবে, সেটাও তিনি ক্রেতাদের ভালমতো শিখিয়ে দিয়ে আসেন! ভাস্করচিত্র যেগুলো (২৪টি) এখনও নিজের কাছে আছে, সেগুলো নিয়ে গত মার্চে একটি একক প্রদর্শনী করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আবিদ। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে তার সেই উদ্যোগটা ভেস্তে যায়। করোনার কারণে এখন ক্রেতা পাচ্ছেন না তিনি। অন্য কোন চাকরিও করেন না। এটাই তার পেশা। তাই বর্তমানে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। দু’ভাবে ভাস্করচিত্র নির্মাণ করেন আবিদ। ক্রেতাদের বর্ণনা মোতাবেক, নইলে নিজের কল্পনা অনুযায়ী। সেক্ষেত্রে ছবির বিষয়বস্তু নির্ধারণে গ্রামই হচ্ছে আবিদের প্রথম পছন্দ। প্রকৃতি, গ্রাম, শ্রমজীবী মানুষ, ঐতিহ্যবাহী স্থান-স্থাপনা ... এগুলোই মূল তার কাজের উপজীব্য বিষয়। তার পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, বাংলাদেশের ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম ... এদের নিয়ে ভাস্কর্য-চিত্র তৈরি করার। ভাস্কর্য-চিত্রের পাশাপাশি ‘শো পিস’ হিসেবে হস্তশিল্পও তৈরি করেন আবিদ (যেমন পাখি, পশু, ফল)। শৈশবে ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু মন বসত না পড়ার টেবিলে। সারাক্ষণ মাটি দিয়ে খেলার নেশা ছিল। মাটি দিয়ে এটা-সেটা তৈরি করতেন। এই নেশাটাই তাকে পরবর্তী জীবনে শিল্পচর্চার দিকে টেনে নিয়ে যায়। আবিদের বয়স যখন মাত্র ৮, তখনই তার শিল্পীসত্তার প্রথম প্রকাশ ঘটে। ইউনেস্কোর সৌজন্যে ঢাকায় একটি শিশুমেলা অনুষ্ঠিত হয় আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে। একজন মহিলা একটি ব্যাগ হতে দাঁড়িয়ে আছেনÑ মাটি দিয়ে এমনই একটি ভাস্কর্য তৈরি করেন। শিশুদের এই প্রতিযোগিতায় আবিদের তৈরি ভাস্কর্যটিই বিচারকদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়। প্রথম পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ওটাই ছিল তার প্রথম পাওয়া কোন পুরস্কার। এর ফলে ভাস্কর্য নিয়ে কাজ করার উৎসাহটা আরও বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ছবি আঁকার নেশাও। এসএসসি পাস করার পর ঢাকার আর্ট কলেজে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। বাধ্য হয়ে কর্মাস নিয়ে অন্য কলেজে পড়েন। কিন্তু তাই বলে ছবি আঁকা ছেড়ে দেনন তিনি। বরং তার সঙ্গে যোগ হয় নতুন এক নেশাÑ ফটোগ্রাফি। ছবি তুলে পরিচিত হওয়া এবং প্রিয়জনদের কাছে অনেক প্রশংসা পাওয়া তার শখ হয়ে ওঠে। একসময় ছবি তুলে বিভিন্ন স্টুডিওর সঙ্গে চুক্তি করে সেগুলো তাদের কাছে বিক্রি করতেন। এভাবেই ক্রমে শিখে ফেলেন ফটোগ্রাফির সব কলাকৌশল। নব্বই দশকের শুরুতে স্টারডাস্ট ভিডিওতে একটি চাকরিও জুটিয়ে নেন আবিদ। ভিডিও ডাবিং ও এডিটিংয়ের কাজ। একদিন জাপানী প্রতিষ্ঠান ‘জাইকা’র একটি ভাষা শিক্ষার বিজ্ঞাপন দেখেন। ৩০০ টাকা দিয়ে তিন মাসের কনর্ভাসেশন কোর্সে ভর্তি হন। আব্দুল মালেক তখন ছিলেন জাইকার সঙ্গে জড়িত। তিনি আবেদকে সাভারে এগ্রিকালচারাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে হাতে-কলমে এগ্রো প্রশিক্ষণ নেন আবিদ। তখন উপলব্ধি করলেন এই শিক্ষাটা কাজে লাগানোর জন্য তাকে গ্রামমুখী হতে হবে। এবং অবশেষে তাই করলেন তিনি...। এরপরের ঘটনা আবিদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জাইকা থেকে স্কলারশিপ দেয়া হবে..., জাপানের ফুকোকার কিউশো দ্বীপের নিশিনিপ্পন ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে এক বছর কাজ শিখতে হবে। জাপানে গিয়ে আবিদ প্লাস্টিক বোর্ডের ওপর এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত শ্রমজীবী মানুষের গরুর গাড়ি ঠেলার ছবিটি (সংগ্রাম)। পেয়েছিলেন অনেক প্রশংসা। অনেক লোক তাকে দেখতে এসে সে দেশের রীতি অনুযায়ী টাই ও একগুচ্ছ ফুল উপহার দিয়েছিলেন। ওই ছবিটি তখন জাপানের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। আবিদ হোসেন বলেন, ‘আমি এখনও শিল্পী হতে পারিনি। এজন্য ধৈর্য, অধ্যবসায় আর চেষ্টা থাকতে হবে। তবে কাজটা করে অনেক আনন্দ পাই। মানুষ হিসেবে আমার জীবনে খুব বেশি চাহিদা নেই। আমার চাওয়া- মেধা, সততা ও পরিশ্রম দিয়েই যেন বেঁচে থাকতে পারি। সুস্থ-সামর্থ্য থাকতেই যেন দুনিয়া ছাড়তে পারি। আর আমার শেষ স্বপ্ন একটা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার। শেষ জীবনটা অসহায়-বঞ্চিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে কাটাব।’
×