ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শঙ্কায় গার্মেন্টস খাত, রফতানি অর্ডার কমেছে ৩০ শতাংশ

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ২৪ নভেম্বর ২০২০

শঙ্কায় গার্মেন্টস খাত, রফতানি অর্ডার কমেছে ৩০ শতাংশ

রহিম শেখ ॥ করোনার প্রথম ঢেউয়ের স্থবিরতা কাটিয়ে জুন মাস নাগাদ ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করে দেশের রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। জুলাইয়ে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক রফতানি আয়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু অক্টোবরেই আবারও পতন হয় রফতানিতে। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ কমেছে তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ। ৬ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত করেছেন বিদেশী ক্রেতারা। উদ্যোক্তারা বলছেন, কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকে নেমে এসেছে অর্ডার। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে অর্ডার ঘাটতির কারণে চরম ক্ষতির মুখোমুখি হবেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, গত বছরের শেষে চীন থেকে নতুন করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। সেই ধাক্কা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে স্পষ্ট হয় মূলত মার্চ মাসের শুরুতে। ২০১৯ সালের মার্চে যেখানে ২৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, চলতি বছরের মার্চে তা ২২৫ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল মাসজুড়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো ছিল কার্যত বন্ধ। এমনকি পণ্য জাহাজীকরণও অনেকটা থমকে ছিল। এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করা সম্ভব হয়; যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৫ শতাংশ কম। এরপর দেশের পোশাক কারখানাগুলো খুলতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এ খাত। গত মে মাসে ১২৩ কোটি এবং জুন মাসে ২২৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির মধ্য দিয়ে ধাক্কা অনেকটা সামলে ওঠা সম্ভব হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও পোশাক রফতানিকারক সমিতির তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ওভেন পোশাক রফতানি খুব ভাল করতে না পারলেও নিট পোশাকের রফতানি ছিল বেশ আশাব্যঞ্জক। সব মিলিয়ে জুলাই মাসে পোশাক রফতানিতে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, এরপর আগস্ট মাসে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু অক্টোবর মাসে এসে আগের বছরের ওই মাসের চেয়ে রফতানি কমে গেছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইতোমধ্যে করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে তৈরি পোশাকের চাহিদাও কমে যাওয়ায় প্রায় ৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছে আন্তর্জাতিক তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো সুইডেনের এইচএ্যান্ডএম, ফরাসী খেলাধুলার সামগ্রী ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিক্যাথলন এবং আয়ারল্যান্ডের প্রাইমার্ক। সংস্থাটির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, ‘এই নিয়ে মোট ৭টি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত অর্ডার বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। মোট ১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার সরাসরি বাতিল হয়েছে আর স্থগিত করা হয়েছে ৪ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার।’ করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হওয়ায় কি পরিমাণ অর্ডার বাতিল হয়েছে তার হিসাব রাখতে একটি ওয়েব পোর্টালও চালু করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তবে বাংলাদেশ থেকে অর্ডার বাতিলের বিষয়টি অস্বীকার করেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ায় এইচএ্যান্ডএম এর আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক জিয়াউর রহমান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, যদি কোন ধরনের অর্ডার বাতিল করে তাহলে ক্ষতিপূরণ দেবে প্রতিষ্ঠানটি। জিয়াউর রহমান বলেন, ‘যেহেতু ইউরোপের কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে লকডাউন শুরু হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে কিছু কিছু পণ্যের শিপমেন্ট আমরা স্থগিত করেছি ২ সপ্তাহের জন্য। অন্য কোন দেশে পণ্যগুলো পাঠানোর পরিকল্পনা আছে আমাদের।’ তবে করোনার প্রথম প্রবাহের সময়ও এমনটাই করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। সে সময় প্রায় ৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল ও স্থগিত করে এইচএ্যান্ডএম, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির প্রায় ১০ শতাংশ। উইন্ডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ উদ্দিন খান বলেন, ‘লকডাউনের কারণে অন্যতম ইউরোপিয়ান বায়ার তাদের অর্ডার ১৮ অক্টোবর থেকে বন্ধ করে রেখেছিল। এখন তারা আবার অর্ডার দেয়া শুরু করলেও পরিমাণে তা খুবই কম।’ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আরও একটি দেশ অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে লকডাউনের কারণে। তবে আগামী ২০ ডিসেম্বর নাগাদ লকডাউন উঠে গেলে আবারও অর্ডার শুরু হবে বলে আশা করেন মেসবাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই কাজের সঙ্কটে আছে ব্যবসায়ীরা। আসছে দিনগুলোতে শ্রমিকদের বেতন আর অন্যান্য খরচ কিভাবে মেটাব, আমরা জানি না।’ ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘বায়ারদের ধরন অনুযায়ী অর্ডারের রকমফের হয়। কয়েকটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান অর্ডার স্থগিত করেছে, তবে কোন অর্ডার এখনও বাতিল করেনি তারা।’ অনন্ত এ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপক শরিফ জহির বলেন, ‘ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশেই লকডাউন চলছে, আর এ কারণেই অর্ডার বাতিল আর স্থগিত করে দিচ্ছেন বায়াররা। অনেক ব্র্যান্ডই তাদের দোকান ও শোরুম বন্ধ করে দিয়েছে।’ করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ যদি দীর্ঘ সময় ধরে চলে তবে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন বলেও জানান শরিফ জহির। বিজিএমইএ এর পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বলেন, ‘কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকে নেমে এসেছে অর্ডার। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে অর্ডার ঘাটতির কারণে চরম ক্ষতির মুখোমুখি হবেন ব্যবসায়ীরা।’ সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে পাওয়া ব্র্যান্ড ক্রেতাভিত্তিক কনটেনার পরিবহনের পরিসংখ্যান নিয়ে একটি জরিপ করেছে বিজিএমই। এতে দেখা যায়, বড় ক্রেতাদের বেশির ভাগেরই রফতানি কনটেনার পরিবহন কমেছে গত অক্টোবর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এইচএ্যান্ডএমের পণ্য পরিবহন করা টোয়েন্টি ফিট কনটেনারের সংখ্যা ছিল ৮৬৩। এ সংখ্যা কমে দ্বিতীয় সপ্তাহে ৭৩০ ও তৃতীয় সপ্তাহে ৫৫০-এ নেমে আসে। পণ্য পরিবহনে প্রাইমার্কের কনটেনারের সংখ্যা অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ২৩০ থেকে নেমে তৃতীয় সপ্তাহে হয়েছে ১৯৬টি। সিএ্যান্ডএফ’র ক্ষেত্রে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ২১০ থেকে তৃতীয় সপ্তাহে কমে হয়েছে ১৮০টি। তবে ওয়ালমার্টের ক্ষেত্রে কনটেইনার পরিবহনের চিত্র ছিল ভিন্ন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওয়ালমার্ট চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৪০ কনটেনার পোশাক পণ্য পরিবহন করলেও তৃতীয় সপ্তাহে তা বেড়ে ৩০০টিতে উন্নীত হয়েছে। বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বিজিএমইএর সংগ্রহ করা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, চলতি নবেম্বর মাসের ১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রফতানি ৭ দশমিক ২২ শতাংশ কম হয়েছে। ২০১৯ সালের নবেম্বরের প্রথম ১৪ দিনে রফতানি হয়েছিল ১০৫ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পোশাক। চলতি নবেম্বরের একই সময়ে রফতানি হয়েছে ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পোশাক।
×