ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মায় দূষণ বাড়াচ্ছে শহরের কঠিন ও তরল বর্জ্য

প্রকাশিত: ২১:২৯, ২৪ নভেম্বর ২০২০

পদ্মায় দূষণ বাড়াচ্ছে শহরের কঠিন ও তরল বর্জ্য

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ক্রমেই দূষিত হচ্ছে রাজশাহীর পদ্মা নদী। শহরের শক্ত ও তরল দুই ধরনের বর্জ্যই মিশে প্রতিনিয়ত পদ্মা নদীর পানির দূষণ হচ্ছে। নদী গবেষকরা বলছেন, নদী দূষণ বাড়তে থাকলে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু যে বসবাসের অযোগ্য হবে তাই না, পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী নগর সংলগ্ন পদ্মার তীর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিনের গৃহস্থালি ময়লা-আর্বজনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে শহরের বুলনপুর, কেশবপুর, শ্রীরামপুর, কুমারপাড়া, শেখের চক, পঞ্চবটি, তালাইমারী ও শ্যামপুর এলাকা শহর রক্ষাবাঁধের পাশে নদীসংলগ্ন হওয়ায় বসবাড়ির সব ময়লা-আর্বজনাই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। এছাড়া শহর রক্ষাবাঁধের বিভিন্নস্থানে বিশেষ করে পাঠানপাড়া, দরগাপাড়া, বড়কুঠি ও শ্রীরামপুরসহ শহর রক্ষাবাঁধের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের রেস্তরাঁ গড়ে উঠায় সব ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া শহরের পাঁচটি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মা নদীতে মিশছে প্রতিনিয়ত। কুমারপাড়া পদ্মার পাড়সংলগ্ন এলাকার এক গৃহিণী বলেন, আমরা এই মহল্লার সবাই বাসাবাড়ির ময়লা ডাস্টবিনে (পদ্মা নদী দেখিয়ে বলেন) ফেলি। আর রাস্তা ঝাড়ু দেয়া ময়লা সিটি কর্পোরেশনের ভ্যান এসে নিয়ে যায়। একই এলাকার সুবাসী দাশ বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ভ্যান কোনদিন আসে সন্ধ্যার দিকে, কোনদিন আসে রাত আটটার পর, ভ্যান খুঁজেই পাওয়া যায় না। এছাড়া গলির ভেতরে ভ্যান না ঢুকায় বাসাবাড়ির সব ময়লা পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। পদ্মা নদী ঘেঁষা কেশবপুর পুলিশ লাইনের সামনের টি-বাঁধের ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায় প্লøাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন। সেইসব বর্জ্য সব পদ্মা নদীতে পড়ে বলে জানালেন গোলাম রসুল নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি ১০ বছর ধরে বাঁধের ওপর পান বিড়ির দোকান করছেন। তিনি জানান, মাস ছয়েক ধরে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছে না। আগে তবু পরিষ্কার করত। এখন প্লাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন ও কাগজের ঠোঙ্গা সব পদ্মা নদীতেই ফেলা হয়। পদ্মা নদী সংলগ্ন বড়কুঠি, পাঠানপাড়া, দরগাড়া, শ্রীরামপুর, তালাইমারী এলাকায় রেস্তরাঁ গড়ে ওঠায় দেখা গেছে সেখানকার সব বর্জ্যই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, শহরের মধ্যে থেকে স্লুইচ গেটের মাধ্যমে যে তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে তার মধ্যে দরগাপাড়া এলাকায় তরল বর্জ্যরে মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। এসব বর্জ্যরে ফলে পদ্মা নদীর পানি দূষণ বাড়ছে। এর ফলে পদ্মায় জলজ জীবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ইতোমধ্যে দেখা গেছে শহরের তরল বর্জ্য বারনই নদীতে পড়ে সেখান জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। মাছসহ জলজ প্রাণীর পরিমাণ বহুলাংশে কমে গেছে। সেভ দ্য ন্যাচার এ্যান্ড লাইফের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য ও পলিথিনের ব্যাগ। এসব নদীর পানির দূষণ বাড়াচ্ছে। পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্য কমিয়ে দিচ্ছে। পলিথিনের ব্যবহার কমানোর আন্দোলন করেও কোন লাভ হচ্ছে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কয়েক বছর আগে পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইচ গেটের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের যে তরল বর্জ্য যাচ্ছে তা গবেষণা করে দেখেছি তাতে দূষণের মাত্রা ব্যাপক। আর এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এছাড়া পানিতে প্লাস্টিক, পলিথিনের বর্জ্য ফেলার কারণেও ব্যাপক মাত্রায় দূষণ হচ্ছে। আগে যেমন পদ্মা নদীতে শুশুক দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায় না। মাছের পরিমাণও বহুলাংশে কমে গেছে। এছাড়া পদ্মা নদীর পানি কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। কারণ গবেষণা দেখা গেছে, পদ্মা নদীর পানি কৃষি কাজে ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এইজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার দূষক পরিশোধনকারী প্ল্যান্ট থাকা উচিত যা রাজশাহীতে নেই। তবে শুধু রাজশাহী একাই যে পদ্মা নদীকে দূষণ করছে বিষয়টা এমন না। পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় থেকে শুরু করে পদ্মা নদীর দুই ধারে অসংখ্য শহর রয়েছে তারাও পদ্মা নদীকে ব্যাপক মাত্রায় দূষণ করছে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, পাঁচটি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে। তবে বর্ষাকালে পদ্মা নদীর পানি বেড়ে গেলে গেট বন্ধ থাকে যাতে পদ্মার পানি শহরে প্রবেশ না করে।রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মোঃ মামুন বলেন, সিটি কর্পোরেশনের তীর সংলগ্ন এলাকায় ভ্যান যাওয়ার কথা। এখন ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সঙ্গে কথা বলা জানতে হবে যে, ভ্যান সেসব এলাকায় পাঠায় কি না। বিষয়টি তিনি তদারকি করবেন বলেও জানান।
×