ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই জেলার চার শীর্ষ নেতাকে অব্যাহতি

দলে ঐক্য রক্ষায় কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ২১:৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২০

দলে ঐক্য রক্ষায় কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দলের ঐক্য রক্ষায় কঠোর অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলীয় উচ্চ পদে থেকে সংগঠনের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে ব্যর্থ এবং বিভেদ-অনৈক্য ও নিজস্ব বলয় সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ‘এ্যাকশন’ নিতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। নরসিংদী জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি প্রদানের পর রবিবার সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককেও স্বীয় পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। দলকে সুসংগঠিত করতে এবং দায়িত্ব অবহেলার কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই জেলার চার শীর্ষ নেতাকে স্বীয় পদ থেকে অব্যাহতি প্রদানের ঘটনা তৃণমূল নেতাদের প্রতি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কঠোর বার্তা বলেই দেখছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। জানা গেছে, শুধু এই দুই জেলায় নয়, সারাদেশেই কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িত নেতাদের খুঁজে বের করে এ রকম কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সম্মেলন হওয়ার পর যেসব জেলার নেতারা কেন্দ্রে পৃথক পূর্ণাঙ্গ কমিটি তালিকা জমা দিয়েছে, বার বার তাগিদ দেয়ার পরও যেসব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজ জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ব্যাপারে একমত হতে পারেননি, সেসব জেলার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কেউ দলীয় শৃঙ্খলা বা দলীয় আনুগত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে কিংবা দলের নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলভঙ্গ করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতি ও শৃঙ্খলার বিষয়। যারা দায়িত্বের প্রতি উদাসীন, যাদের দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে দায়িত্বে অবহেলা আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতেও যেখানে এই ধরনের সমস্যা আছে সেখানেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। রবিবার আওয়ামী লীগের সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মোঃ হাবিবে মিল্লাতকে স্বীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। দলটির সভানেত্রীর নির্দেশক্রমে ও সংগঠনের গঠনতন্ত্রের বিধি মোতাবেক এই অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ। একইসঙ্গে পরবর্তী কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রবিবার আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। তবে চিঠিতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ বিশ্বাস ও জাতীয় সংসদ সদস্য হাবিবে মিল্লাত মুন্নাকে অব্যাহতি দেয়ার কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী বিভাগের আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, দলের সভানেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দলের ঐক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে যেমন সারাদেশের তৃণমূল মানুষের খোঁজখবর রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন, তেমনি দলের প্রধান হিসেবেই তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সব ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখেন। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েও সংগঠনের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে না পারা, দলের জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দলের হাইকমান্ড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা তৃণমূলের নেতাদের প্রতি দলীয় প্রধান, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার একটি সতর্কবার্তা বলেও আমি মনে করি। জানা গেছে, দলের এই কঠোর অবস্থানের কারণেই গত ১৯ নবেম্বর দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থতা এবং দলীয় কোন্দল এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করার অভিযোগ এনে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়াকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। একইসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জি এম তালেবকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা কাজী মোঃ আলীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ ও নরসিংদীতে দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ দুইভাগে বিভক্ত। জেলার নেতাদের কোন্দলের জের ধরে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। চলতি বছরের ৭ জুলাই সিরাজগঞ্জে প্রতিপক্ষ ছাত্রলীগের মারধরে ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক বিজয় নিহত হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের একাংশ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। অভিযোগ করা হয়, জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কোন্দলের কারণেই এমন দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আরও কিছু অভিযোগের সত্যতা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সামনে আসার পরই জেলা দুই শীর্ষ নেতাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে নরসিংদী জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ জেলাতেও দলের নেতাকর্মীরা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। দলীয় কোন্দল এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, দলীয় সভা-সমাবেশেও জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক মঞ্চে আসনেনি। জানা গেছে, গত ৮ মার্চ নরসিংদীর মনোহরদীতে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হূমায়ূনের বাসভবনে দলের জরুরী বর্ধিত সভাতে ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সবার সামনে বিভেদ ভুলে মিলিয়ে দেন। কিন্তু সভা শেষে আবারও তারা বিভেদের রাজনীতিতেই জড়িয়ে পড়েন। এ সব তথ্য জানার পরই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী জেলার এই দুই শীর্ষ নেতাকেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শুধু সিরাজগঞ্জ কিংবা নরসিংদীই নয়, দলের ঐক্য বিনষ্টকারী এবং দলীয় কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া কয়েকটি জেলার নেতাদের বিরুদ্ধেও এ্যাকশনে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। সম্মেলন হওয়ার পর প্রায় ৩৪ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রে পূর্ণাঙ্গ কমিটির জন্য তালিকা জমা দিয়েছেন। সেখানে দেখা গেছে, কয়েকটি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঐক্যবদ্ধ হয়ে একক তালিকা জমা দিতে পারেননি। ওই সব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পৃথক পৃথক তালিকা কেন্দ্রে জমা দিয়েছেন। জানা গেছে, ওইসব জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা একাধিকবার কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ঢাকায় তলব করে বৈঠক করেছেন এবং দু’জনে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ একটি তালিকা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপরও কয়েকটি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একমত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একক তালিকা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব বিষয়গুলোও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দলের হাইকমান্ডের সামনে তুলে ধরেছেন। এ সময় হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেসব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা সংগঠনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে এবং নিজের বলয় সৃষ্টিতে বিতর্কিতদের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান দিয়ে জেলার ত্যাগী-আদর্শিক নেতাদের বঞ্চিত করেছে- তাদেরও একটি পৃথক তালিকা তৈরি করতে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য জেলার শীর্ষ নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে না পারে, তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
×