ইতিহাসে সময়ের ওপর ভর করে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অনেকেই সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন, ছাড়িয়েছেন নিজের প্রত্যাশাকে, হয়েছেন খ্যাতিমান। যুগে যুগে অনেক নেতাকেই দেখা গেছে সমালোচনার ঝড় তুলে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে দায়িত্বশীল জায়গায় বসে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এ জন্যই ‘ইট ইজ ইজি টু সে বাট ডিফিকাল্ট টু ডু’র মতো কিছু বাণী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ পার্টির দিকে তাকাই তা হলে দেখতে পাই তারা সরকারের সমালোচনা করে ধুয়ে দেয়। তাদের কথা শুনলে মনে হয় তাদের সরকারের কোন ব্যর্থতাই ছিল না বা এসবের কোন কিছুই তাদের আমলে ঘটেনি। অথচ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তাদের সময়ে যা ঘটেছে তা বলার বাইরে। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল বিএনপি-জামায়াতজোট সরকার। শুধু তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টায় হামলা করা হয়েছে ১৯ বার। ২১ আগস্টের মতো বর্বরোচিত হামলা, গ্রীন রোডে ভোট পরিদর্শনে গেলে বিএনপি নেতা ওয়াহিদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার ওপর হামলা, ’৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নাটোরে রেলগাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া, ৭ মার্চের ভাষণে রাসেল স্কয়ারে গুলিবর্ষণ, শেখ হাসিনা এবং তার পুত্র-কন্যাকে হত্যায় পুরস্কার ঘোষণা, বোমা পুঁতে রাখা, শেখ হাসিনার গাড়ি বহর আটকে হামলার মতো পাশবিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ছাড়াও ভালবাসা দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বোমা হামলা, বিচারকের ওপর হামলা, খুলনায় সাংবাদিক হত্যা, নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে পরিবারসহ জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া, ধর্ষণের মতো জঘন্যতম কোন অপরাধ নেই যা বিএনপি আমলে হয়নি। এতসবের পরেও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন দেশে খুন বেড়েছে, সন্ত্রাস বাড়েনি। তাদের মুখে যখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনি তখন মনে হয় এ যেন ভূতের মুখে রামরাম।
আমরা যদি বাম দলগুলোর রাজনীতি দেখি তাদের চিত্রও প্রায় একই। তাদের কাজই সরকারের ভুল ত্রুটি খুঁজে বের করে কয়েকটি কুপি, মাইক নিয়ে রাস্তায় গিয়ে আন্দোলনের নামে পরিবেশ নষ্ট করা। অথচ দেখা যায় এ পর্যন্ত বাম থেকে যারা সরকারের দায়িত্বশীল জায়গায় থেকেছেন ব্যর্থতার তালিকা করলে সাধারণ মানুষও তাদের নামটি টেনে আনবেন প্রথমে।
প্রায় ৩০ বছর পর হওয়া ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ভিপি হলেন নুরুল হক নূর। নির্বাচিত হয়ে তিনি যতটা না ছাত্র রাজনীতি করেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছেন জাতীয় রাজনীতি। অনেকটা ফসলের চেয়ে আগাছা বেশি অবস্থা। তিনি যে-ই ভিপি পদের ব্যবহার করে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের কুৎসা রটানোতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন, সেই ভিপি পদের নির্বাচনে তথা ডাকসু নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সদিচ্ছা ছিল কাদের? সেই সত্য কথাটি কি ভিপি নূর কখনও বলেছেন? কখনও ধন্যবাদ দিয়েছেন? নিন্দা আর বদনাম ছড়ানো ছাড়া কখনও ধন্যবাদ দিয়েছেন কী? ডাকসু নির্বাচন দেয়া প্রতিষ্ঠানের কাজ। কিন্তু ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ না থাকলে যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয় সেই ‘ওপেন সিক্রেট’ সত্যটি গত তিন দশকে সবাই দেখেছে ও বুঝেছে।
ভিপি নূর ও তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের একটি ইতিবাচক দিক হলো তারা বঙ্গবন্ধুকে মান্যতার কথা বলেন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুকে তারা শ্রদ্ধা করেন, স্মরণ করেন-তাদের এই দিকটি ইতিবাচক মনে হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন তারা বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করবেন- এটাই স্বাভাবিক।
ভিপি নূরের জনপ্রিয়তা মূলত এ্যান্টি আওয়ামী লীগার জনপ্রিয়তা। তার অবদান তিনি বড় গলায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। তার অনুসারীদের ভাষায় তিনি ‘সাহস করে সত্য বলা’ নেতা। কিন্তু ঠিক এই ‘সত্য’ ব্যাপারটি নিয়ে বেশ খটকা রয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয় তিনি ‘সাহস করে আওয়ামী লীগের বদনাম প্রচারকারী নেতা। কেননা, তিনি যদি সত্যই বলেন তাহলে তার বক্তব্য শুনলে মনে হবে-আওয়ামী লীগের কোন অবদান নেই, কোন অর্জন নেই। একটা ব্যাপার হলো-কেউ কাজ করছে তার সমালোচনা করে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করা। আরেকটা ব্যাপার হলো কাজ করেও কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য অনেকের কাছে বিরাগ-ভাজন হওয়া। আজকে এই মুহূর্তে যদি নূরুল হক নূর কোন ক্ষমতা পান তাহলে তিনি কতটা সফল হতে পারবেন বলে আপনি মনে করেন? ভিপি পদে থেকে তিনি ‘সরকারের সমালোচনা’ ছাড়া আর কি এমন করতে পেরেছেন ছাত্রদের জন্য? হয়তো তিনি ভিপি হওয়ার আগে ছাত্রদের জন্য একটি আন্দোলন করেছেন। এখানে লক্ষ্য করতে হবে-আন্দোলন করে কোন দাবি আদায় করা আর কোন দাবি ক্ষমতায় থেকে বাস্তবায়ন করা এক জিনিস নয়। কারও কাছ থেকে টাকা চাওয়া আর টাকা উপার্জন করা এক জিনিস নয়। এটি বুঝতে ভুল করলে জাতি শেয়ালের কাছে মুরগির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে বসতে পারে।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ও ভিপি নূরসহ তাদের দলের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে, সেই মামলায় ভিপি নূরকে গ্রেফতারের দাবি করা হলো। তখন বলা হলো সরকার ষড়যন্ত্র করে ভিপি নূরের কণ্ঠরোধ করার জন্য এই মামলা দায়ের করেছে এবং ভিপি নূরকে আটক করেছে! আবার ভিপি নূরকে ডিবি যখন ছেড়ে দিল তখন বলা হলো আন্দোলনের ভয়ে সরকার ভিপি নূরকে ছেড়ে দিল! এখানে ‘সাহস করে সত্য বলা’ নেতা ও তার অনুসারীদের একটি স্পষ্ট সাংঘষিক বক্তব্য দেখতে পেল মানুষ। যদি কণ্ঠরোধ করার জন্য ভিপি নূরকে আটক করা হয়ে থাকে, তাহলে ভিপি নূরকে ছেড়ে দিলে কণ্ঠকে ছেড়ে দেয়া হবে না কেন? ভিপি নূর ও তার দলকে মনে রাখতে হবে তারা বিএনপির চেয়ে বেশি সংগঠিত কোন দল নয় যে, সরকার তাদের ভয় পাবে। ভিপি নূর যতটা না নিজের যোগ্যতায় সারাদেশে একজন নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে। তাই বিষোদ্গার করা সস্তা জনপ্রিয়তায় বিভ্রান্ত না হয়ে ভাল কাজের মূল্যায়নই হতে পারে দায়িত্বশীলতার পরিচয়।
লেখক : ছাত্রনেতা