ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আরবান মাঙ্কিকে কলা দিয়ে আপ্যায়ন

খাবারের অভাবে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্য হারিয়ে লোকালয়ে বানর

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২২ নভেম্বর ২০২০

খাবারের অভাবে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্য হারিয়ে লোকালয়ে বানর

মোরসালিন মিজান ॥ রাজধানী শহর এখন শুধুই মানুষের। মানুষই দখলে নিয়েছে সব। কত বন বৃক্ষ প্রাণী উজাড় হয়ে গেছে! কে তার খবর রাখে? একইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বানর। শহুরে সভ্যতার ভারসাম্যহীন বিকাশ জীবন বিপন্ন করে তুলেছে ওদের। কোভিডের কাল শুরু হওয়ার পর হয়তো আরও খারাপ যাচ্ছে সময়টা। মানুষ এখন ঘরমুখো। নিজের সুরক্ষা নিয়ে অধিক ব্যস্ত। এর প্রভাব পড়েছে শহুরে বানরের জীবনেও। খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। চলছে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি। বিভিন্ন দলে বিভক্ত বানরেরা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। কোন কোন দলপ্রধান সা¤্রাজ্য হারিয়ে পালিয়ে আসছে লোকালয়ে। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় হঠাৎই দেখা মেলে এক বানরের। এত ব্যস্ত স্থানে বানরের উপস্থিতি কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। তাতে কী? প্রাণীটি চলে এসেছিল ঠিকই। দুপুরের দিকে হঠাৎ এর উপস্থিতি চোখে পড়ে। ক্লাবের মূল ভবনের অগ্রণী ব্যাংক অংশের ছাদে এসে বসেছিল। সাধারণত বানর মানেই চঞ্চল। অস্থির চিত্ত। দৌড়ঝাঁপ করতেই বেশি দেখা যায়। খুনসুঁটি চলে নিজেদের মধ্যে। মুখে একটা ভেটকি লেগে থাকে সব সময়। এ বানরটির বেলায় তেমন কিছু দেখা গেল না। বরং অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। বিষণœ চেহারা। ফাঁপা ফোলা লোমশ শরীর। খুব বেশি নড়াচড়া করার শক্তি নেই গায়ে। দেখে বোঝা যায়, বয়স অনেক হয়েছে। বানরটির এক হাতে সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া কোন আঘাতের চিহ্ন। ত্বকের বেশ খানিকটা চিড়ে গেছে। চোখেমুখে তার ভয়। একলাটি হয়ে নতুন জায়গায় আসা বানর মানুষের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছিল না। তাই দূর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পেরে অতিথি আপ্যায়নে উদ্যোগ নেন কৌতূহলী মানুষ। এক কিশোর পাশের দোকান থেকে কলা কিনে এনে বানরের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। তাতেই কাজ হয়। নিচে নেমে আসে সে। পরে আরও অনেকে তার দিকে বিস্কুট কলা ড্রাইকেক ছুড়ে মারতে থাকে। এভাবেই প্রায় দশ মিনিট ধরে চলে আপ্যায়ন। সমবেত হওয়া কৌতূহলী মানুষের থেকে একটু দূরে বসে খাবার গ্রহণ করে বানরটি। গোগ্রাসে গিলতে থাকে। দেখে বোঝা যায়, ক্ষুধার্ত সে। এ ধরনের আরবান বানর মূলত দেখা যায় পুরান ঢাকায়। গে-ারিয়া, বনগ্রাম, ওয়ারী, সুরিটোলা, কলতাবাজার, শাঁখারীবাজার, সূত্রাপুর, নারিন্দা, রাধিকা বসাক লেন, মিলব্যারাক, স্বামীবাগ এলাকায় একটু অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকালে প্রাণিটির দেখা মেলে। এ বানরগুলো ‘রেসাস ম্যাকাস’ প্রজাতির। বঙ্গভবন, ক্যান্টনমেন্টসহ আরও কিছু এলাকায় বানরের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা বানর দেখা যায় গে-ারিয়ায়। দীননাথ সেন রোডে অবস্থিত সাধনা ঔষধালয় ও এর আশপাশের এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো এই বানরের রাজ্য। তবে প্রেসক্লাব এলাকায় বানর দেখার ঘটনা বিরল। উপস্থিত প্রায় সবাই স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, এর আগে এখানে কোনদিন বানর দেখেননি তারা। তাই কৌতূহল বাড়ছিল। বাড়ছিল দর্শনার্থীর সংখ্যা। ফটোসাংবাদিকরা ক্যামেরা তাক করে রেখেছিলেন তারও আগে থেকে। সব মিলিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় বানরটি। দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে। তার পরপরই অনেকটা ম্যাজিশিয়ানের কবুতরের মতো অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু প্রেসক্লাবের মতো এমন ব্যস্ত এলাকায় বানরের আমদানি হলো কী করে? কোথা থেকে কিভাবে এলো বানর? শুধুই কি খাবারের সন্ধানে এ পর্যন্ত চলে এসেছিল? বানরটিকে এত বিষণœইবা মনে হচ্ছিল কেন? দর্শনার্থীরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। নিশ্চিত কোন উত্তর সেখান থেকে পাওয়া গেল না। পরে পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজের সঙ্গে। চমকিত হওয়ার মতো ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, মানুষের মতো বানরের মধ্যেও দলাদলি আছে। এরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বাস করে। প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে একদল আরেক দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। দলগুলোর নেতৃত্বে থাকে কোন এক বয়স্ক বানর। গায়ে যতদিন শক্তি থাকে, যতদিন জয় এনে দিতে পারে ততদিন দলপ্রধানের পদ ধরে রাখতে পারে সে। তা না হলে এক পর্যায়ে সা¤্রাজ্য হারায়। দলচ্যুত হতে হয়। প্রেসক্লাবে দেখা বানরের সকল বর্ণনা ভাল করে শুনে নিয়ে তিনি বলেন, অনুমান করছি, এটিও যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে সা¤্রাজ্য হারানো বানর। কিছুদিন আগে পর্যন্ত হয়তো কোন দলের প্রধান ছিল। কিন্তু বার্ধক্যে পড়ায় গায়ে আগের মতো শক্তি নেই। তাই সংঘর্ষে জড়িয়ে পরাস্ত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে নিজ দল থেকে। তিনি বলেন, বানর সোশ্যাল এনিম্যাল। নিজেদের মতো করে খাবার সংগ্রহ করতে পারে। তার পরও এ খাবার নিয়েই ওদের মধ্যে বেশি সংঘর্ষ হয়। এখন কোভিডের কাল। আগের মতো খাবার জুটছে না। হয়তো তাই সংঘর্ষও বেড়েছে। সংঘর্ষে হেরে বানরটি পালিয়ে এসেছে বলেই পর্যবেক্ষণ দেন তিনি। তার মতে, প্রেসক্লাব থেকে খুব বেশি দূরে নয় বঙ্গভবন। ওয়ানম্যান গ্রুপের বানরটি সেখান থেকে আসতে পারে বা আসতে পারে পুরান ঢাকার গে-ারিয়া থেকেও। তবে যেখান থেকেই আসুক, ওরা বাঁচার জন্য আসে। বিশেষ করে কোভিডের কালে লোকালয়ে চলে আসা বানরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
×