ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার ভূস্বর্গ, খুমের স্বর্গরাজ্য বান্দরবান ছুটছেন পর্যটকরা

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২২ নভেম্বর ২০২০

বাংলার ভূস্বর্গ, খুমের স্বর্গরাজ্য বান্দরবান ছুটছেন পর্যটকরা

ওয়াজেদ হীরা, বান্দরবান থেকে ফিরে ॥ বান্দরবান যেন বাংলার এক ভূস্বর্গ। উঁচু নিচু পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে নানা সৌন্দর্য দেখতে ছুটে যান পর্যটকরা। পাহাড়ের সৌন্দর্যে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত করেছে আবিষ্কার হওয়া বিভিন্ন খুম, যা পাহাড় বেষ্টিত এক ধরনের জলপ্রপাত। এগুলো দেখতে অনেকটা গুহার মতো। মারমা ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। আর বান্দবানের বিভিন্ন খুমের প্রতি বেশি আকর্ষণ বর্তমান তরুণদের। দুর্গম এলাকা হওয়ায় দলবেধে স্থানীয় গাইডের দিক নির্দেশনায় বিভিন্ন খুমের সৌন্দর্যে ছুটছেন তরুণরা, কেউ নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করছেন। সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য দুর্গম হওয়ায় এসব এলাকায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কথা বলছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আগস্ট মাসের শেষের দিকে খুলে দেয়া হয় বান্দরবানের বিভিন্ন দর্শনীয়স্থান। এরপর থেকে পাহাড়ে ছুটছেন অনেকেই। পাহাড়ী জেলা বান্দরবানকে বলা হয় খুমের স্বর্গরাজ্য আর এই খুমের রাজা হচ্ছে দেবতাখুম। বান্দরবানে এখন পর্যন্ত যে সকল খুমে পর্যটক যাচ্ছে তার মধ্যে দেবতাখুম, ভেলাখুম, নাফাখুম, আমিয়াখুম সাতভাইখুম ইত্যাদি। তবে বেশিরভাগ খুবই দুর্গম এবং বেশ সময় ধরে হাঁটতে হয় বলে তরুণদের জন্য উপযোগী। বয়স্ক বা পরিবারে শিশু থাকলে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছেন না। তবে এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তরুণ-তরুণীরা ছুটছেন খুমের প্রকৃত সৌন্দর্য দেখতে। পাহাড়ী উঁচু নিচু পথ কখনও জঙ্গল বা নদী পেরিয়ে হেঁটে যেতে হয় এ সকল খুমে। একটা সময়ের পরে গাড়ির রাস্তা না থাকায় প্রত্যেকটা খুমে যেতে কমপক্ষে এক থেকে কয়েক ঘণ্টার হাঁটার পথ রয়েছে। তবে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে তা কোন বাধাই নয়। জানা গেছে, পাহাড়ী নদী সাঙ্গু তার বয়ে চলার পথে অজস্র স্থানে ছোট ছোট জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এ সকল খুম। নাম না জানা আরও অনেক খুম আছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এক দশক আগেও এ সকল খুমের নাম ছিল অজানা। গত কয়েকবছর ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসাতে বর্তমানের তরুণদের প্রধান আকর্ষণ পাহাড়ী পথে ট্রেকিং এবং সেই খুমের সৌন্দর্য দেখা। দুই পাশে সবুজঘেরা পাহাড়ের মধ্যদিয়ে স্বচ্ছ পানির ধারা আর এ সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতিনিয়ত ভিড় বাড়াচ্ছেন তরুণরা। বিপুলসংখ্যক তরুণ এ সকল খুম দেখতে গেলেও এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রাকৃতিক হিসেবেই রাখতে চান তারা। তবে রাস্তাঘাট উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে পর্যটন মন্ত্রণালয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মহিবুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ী এলাকায় এ সকল খুমের প্রতি তরুণদের ব্যাপক আগ্রহের বিষয়টি আমরাও অবহিত। তবে এখানে যাতায়াত উন্নত করার বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা প্রত্যেকটি রাস্তার তালিকা করেছি, প্রত্যেকটি রাস্তার একটি আইডি নম্বর আছে। রাস্তার তালিকাটা আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি এজন্য যে তারা যেন আমাদের রাস্তাগুলো করে দেয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন বলেও জেনেছি। সরেজমিনে দেবতাখুম ভেলাখুমে দেখা গেছে পর্যটকদের সরব উপস্থিতি। যদিও এ সকল দুর্গম এলাকায় যেতে স্থানীয় থানা ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে অনুমতি এবং সঙ্গে গাইড থাকা বাধ্যতামূলক। অনুমোদন নেয়ার পূর্বে অবশ্যই প্রত্যেক ভ্রমণকারী সদস্যদের ভোটার আইডি কার্ড বা কোন পরিচয় পত্রের ফটোকপি দিতে হয়। বান্দরবানের স্থানীয়দের মতে, দেবতাখুম এটি প্রায় ৫০ ফুট গভীর এবং প্রায় ৬০০ ফুট দীর্ঘ। এই খুমের দুইপাশে রয়েছে বিশাল জঙ্গল। খাড়া পাহাড়ের কারণে খুমের ভেতর সরাসরি সূর্যের আলো পৌঁছায় না। তাই খুমের যত ভেতরে যাওয়া যায় ততই শীতল মনে হয়। জায়গাটি খুব শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত। এর পানিও স্বচ্ছ। বাঁশের ভেলায় চেপে এই খুমের ভেতর যাওয়া পর্যটকদের এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়। অবশ্য নৌকাতেও অনেকে যেতে পারেন। যেখান থেকে ভেলায় ভেসে যাত্রা শুরু হয় সেই অংশকে ভেলাখুম বলেন স্থানীয়রা। দেবতাখুম বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়িতে অবস্থিত। গাড়িতে সরাসরি রোয়াংছড়ির কচ্ছপতলী বাজার পর্যন্ত যাওয়ার পর সেনা ক্যাম্পের অনুমতি সাপেক্ষে ঘণ্টাখানেক হাঁটা পথ। পাশের পাহাড়ের নাম দেবতা পাহাড় আর তারই নামের কারণে একে দেবতাখুম বলে। দেবতাখুমের আগে পং সু আং নামের আরেকটি খুম পার হতে হয়। বর্ষাকালে এই খুমে যাওয়ার ট্রেকিং পথ কিছুটা দুর্গম হয়ে ওঠে বলে বেশিরভাগ পর্যটন শীতকালকেই বেছে নেন। সাঁতার জানা থাকলে বা না থাকলে খুমের ভেতর যাওয়ার আগে লাইফ জ্যাকেট পরে নেয়ার কথা বলেন স্থানীয় গাইড। স্থানীয় গাইড শিশির বলেন, প্রতিদিন শত শত মানুষ দলবেঁধে আসে দেখতে। অনেক সময় ভেলা সঙ্কটের কারণে ভেলাখুম থেকে অনেক পর্যটক দেবতাখুম না গিয়েও ফেরত যেতে হয়। এ সকল খুমে গত ২ থেকে ৩ বছর আগেও হাতে গোনা কিছু মানুষ আসত তবে এখন সে সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি বলেন শিশির। তবে খুমের আশপাশে থাকার জন্য এখনও কোন পরিবেশ গড়ে উঠেনি। সহসাই সে মানের থাকা খাওয়ার কোন হোটেল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। দুর্গম এলাকা হওয়ায় অনেকটাই নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। তবে স্থানীয় মারমা, চাকমা বা অন্যান্য আদিবাসীদের থাকার জন্য পাড়াতে অনেক সময় পর্যটকরা রাত কাটান। পর্যটক আবেদিন হোসাইন বলেন, সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে যাতায়াত অনেকটা কষ্টের হয় এরমধ্যে থাকা খাওয়ার বিষয়টাও বেশ কষ্টের। সহজে আসার রাস্তা থাকলে এসে আবার চলে যাওয়া যায়। কিংবা থাকা খাওয়ার জন্য ভাল ব্যবস্থা দরকার। বান্দরবানের থানচি উপজেলায় দুর্গম দৃষ্টিনন্দন স্পট নাফাখুম। জলপ্রপাতের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় হওয়ায় বাংলার নায়াগ্রা হিসেবে খ্যাত নাফাখুম। থানচি উপজেলার মারমা অধ্যুষিত রেমাক্রি এলাকায় থাকা খাওয়ার কিছুটা ব্যবস্থা রয়েছে তবে সেটা তেমন উন্নতমানের নয়। রেমাক্রি থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি হাঁটা পথ যাওয়ার পর সেই নাফাখুম। বান্দরবানের থানচিতেই অবস্থিত আমিয়াখুমের ঝর্ণা। এখান থেকে সামান্য ওপরে উঠলেই শুরু হয় ছোট-বড় অনেক পাথর দিয়ে সাজানো পাথুরে রাস্তা। খুব সাবধানতার সঙ্গে রাস্তাটুকু পার করার পরে সামনে পড়বে বিশাল আকৃতির পাথরের পাহাড় আর তার মাঝে সবুজ, শান্ত ও স্বচ্ছ জলধারা। আর এখান থেকেই শুরু সাতভাইখুম। থানচি থেকে নৌকায় রেমাক্রি যাওয়ার পর অবলম্বন পায়ে হাঁটা পথ। রেমাক্রি থেকে কয়েক ঘণ্টার হাঁটা পথ। থাকার জন্য স্থানীয় উপজাতিদের ঘর একমাত্র ভরসা। সরেজমিনে বান্দরবানের ঘুরতে আসা বিভিন্ন পর্যটক গ্রুপ জানান প্রাকৃতিক পরিবেশের এ সকল সৌন্দর্য সবাই উপভোগ করতে চায় এজন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি জরুরী। যে সকল স্থানে রাস্তা নেয়ার সুযোগ আছে সেখানে রাস্তা করা হলে আরও অন্যান্য বয়সের মানুষ আসতে পারে।
×