ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২২ নভেম্বর ২০২০

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে

নিখিল মানখিন ॥ বাংলাদেশে নবেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এসে হঠাৎ করে আবার রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ দেশে করোনা শনাক্তের ৪৬তম সপ্তাহের তুলনায় ৪৭তম সপ্তাহে করোনায় মৃত্যুর হার ৪২ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং শনাক্তের হার ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শনাক্তের হার বৃদ্ধি ভাল করোনা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র প্রকাশ করে। এমনিতেই বিশ্বের অনেক দেশে করোনা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশও দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধিসহ প্রয়োজনীয় সরকারী নির্দেশনা মানা না হলে দেশে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত সাত মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে করোনায় দৈনিক রোগী শনাক্ত, শনাক্তের হার ও মৃতের সংখ্যা ওঠানামা করছে। খুব বেশি বাড়েও না, কমেও না। এর মধ্যে গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার একটু একটু করে কমে আসছিল। যদিও নমুনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার কখনোই দশ শতাংশের নিচে নামেনি। কিন্তু হঠাৎ করে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের করোনা পরিস্থিতির বেশ অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। নতুন করে ঘোষণা করা হয়েছে লকডাউনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা। উঠানামার মধ্যেও গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে করোনায় শনাক্তের হার বেড়েছে। রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা ছাড়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় দেশে দৃশ্যমান কর্মসূচী নেই। দেশে বিরাজ করছে করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন জরিপ এবং দৈনিক রোগী শনাক্তের হার দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ এখনও করোনার প্রবল থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বাংলাদেশের করোনার প্রথম ঢেউয়ের স্থায়িত্ব বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবে দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার নির্দেশনা ও প্রস্তুতি ॥ বাংলাদেশে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে সরকার বলে আসছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শীতে বাড়বে। সেজন্য কয়েকবার প্রস্তুতি নেয়ার তাগিদও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা ছাড়াও মহামারী নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারাও কয়েকবারই পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুতির কথা বলেছেন। যে কারণে এ সপ্তাহে যখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেল, সবাই একে দ্বিতীয় ধাপের সঙ্গে মেলাতে শুরু করেছেন। দ্বিতীয় ঢেউ আসলে তা মোকাবেলায় সরকার পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে রবিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় পূর্বের সকল প্রস্তুতি ধরে রেখে কাজ করা হচ্ছে। ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো যেভাবে করোনার জন্য কাজ করেছে তা অব্যাহত রাখা হবে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ চলমান থাকবে। পিপিই দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে তা ভবিষ্যতেও মজুদ থাকবে। এর পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোকে প্রচারণা আরও বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে কোভিড এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতেও অবগত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকারী সেবা নিতে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলকও করা হয়েছে যাকে ইংরেজীতে তুলে ধরা হয়েছে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’। খুব দ্রুতই করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেন, শীতে সংক্রমণ বাড়বে সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে নানা রকম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, এতদিনে আমাদের চিকিৎসকেরা জানেন কিভাবে এই রোগের চিকিৎসা করতে হবে, এবং শুরুতে মাত্র কয়েকটা ল্যাবরেটরিতে টেস্টিং হত, সে সংখ্যা এখন ১১৭টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। মাঝখানে সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় আমরা ভেবেছিলাম আমাদের প্রস্তুতি কিছুটা সঙ্কুচিত করে নিয়ে আসব। এখন আর সেটা করা হচ্ছে না। অতিরিক্ত মহাপরিচালক আরও বলেন, ঢাকায় ও প্রতিটি জেলায় যতগুলো হাসপাতালকে আমরা কোভিডের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম, সেগুলো কোভিডের জন্য প্রস্তুত থাকবে। যদিও নন-কোভিড অসুখের জন্য এখন সেগুলোর কিছু অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু রোগীর সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায় তখন যাতে ব্যবহার করা যায়, সেভাবে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে বলে জানান অতিরিক্ত মহাপরিচালক। তিনি বলেন, প্রয়োজনে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো হবে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা কবে থেকে বাড়বে, আর কিভাবে সেটা করা হবে, তা নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। রোগীর সংখ্যা বাড়ার আগে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চায় সরকার, সেজন্য এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপরে সরকার কঠোর হচ্ছে বলে জানান মীরজাদী ফ্লোরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ সামাল দিতে হলে নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। তারা বলছেন, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে যতদ্রুত সংক্রমিত মানুষ চিহ্নিত করা যাবে, তত দ্রুত তার চিকিৎসা এবং পরিবারের অন্যদের আইসোলেশনে রাখা এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডাঃ ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, প্রথম দফার সময় যে আকস্মিক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। পিপিই এখন আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে আছে। একইসঙ্গে নমুনা পরীক্ষার কিটের সংখ্যাও পর্যাপ্ত পরিমাণে কেনা হয়েছে। এরপর ল্যাব তখন নতুন করে করতে হয়েছিল, এখন তো আমাদের ১১৭টি আছে, প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে। আবার অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা অনেকগুণ বাড়ানো হয়েছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম ছিল না অনেক জেলায়, এখন অনেক জেলায় স্থান করা হয়েছে। এছাড়া নতুন করে সারাদেশে ৯২টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম বসানোর কাজ চলছে, যেগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। ডিসেম্বর মাস থেকেও নতুন আরও কয়েকটি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম বসানোর কাজ শুরু হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ভার নিজেদেরকেই নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ মুস্তাক হোসেন। তিনি বলেন, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বিধি নিষেধসমূহ শিথিল করেছে সরকার। করোনা সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে। করোনা প্রতিরোধের বিষয়সমূহও অজানা থাকার কথা নয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিজেদেরকেই করে নিতে হবে। করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে স্থবিরতা ॥ দেশের করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে করোনা মোকাবেলার নির্দেশনাসমূহ। নিজেদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিজেদেরকেই করে নিতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বিধি- নিষেধসমূহ শিথিল করেছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও কঠোর বিধি-নিষেধ কার্যকর নেই। স্বাস্থ্যবিধি পালনসহ কিছু নির্দেশনা পালনের বিষয়টি বলবৎ রয়েছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠে নেই কোন কর্তৃপক্ষ। ফলে করোনা পূর্বকালীন স্বাভাবিক সময়ের মতো চলাফেরা এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করছেন সাধারণ মানুষ। তাদের স্বাভাবিক চলাফেরায় মনে হবে করোনার দিন শেষ হয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন জরিপ এবং দৈনিক রোগী শনাক্তের হার দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ এখনও করোনার প্রবল থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিধি-নিষেধসহ বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সরকার। পরবর্তীতে দেশের মানুষের জানমালের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একে একে প্রায় সবক’টি বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা ছাড়া দেশের মানুষের জীবনযাত্রা যেন স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, মাস্ক পরিধান, অপ্রয়োজনে বাসার বাইরে না যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। শিথিল করা মানে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা নয়- এই নির্দেশনাটি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে ওইসব নির্দেশনা পালন না করার কারণে দেশে যেন করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা।
×