ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ভ্যাকসিন ॥ শীঘ্রই আশার আলো

প্রকাশিত: ২০:৫২, ২২ নভেম্বর ২০২০

করোনা ভ্যাকসিন ॥ শীঘ্রই আশার আলো

মার্কিন ওষুধ কোম্পানি ফাইজার জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেকের সঙ্গে যৌথভাবে কোভিড-১৯ এর যে টিকা বের করেছে শেষ ধাপের পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলের ভিত্তিতে তারা দাবি করেছে যে, এই টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। এখন শুধু সরকারী অনুমোদন পাওয়ার জন্য অপেক্ষার পালা। করোনাভাইরাসের হিংস্র নখরাঘাতে সারা বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত ও দিশেহারা তখন এই ঘোষণা সহসাই ঘোর অন্ধকারে আশার আলোর ঝলকানি হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা গেছে অন্যান্য কোম্পানি যেসব ভ্যাকসিন বা টিকা বের করেছে সেগুলোও কমবেশি কার্যকর হবে। এ পর্যন্ত ৩২০ টিরও বেশি টিকা উদ্ভাবিত হবার পথে রয়েছে। বেশ কয়েকটি শেষ ধাপের পরীক্ষার স্তরে আছে। ফাইজারের মতো বেশিরভাগ কোম্পানির মূল সৃষ্টি স্পাইক প্রোটিনকে ঘায়েল করার ওপর নিবদ্ধ। এই স্পাইক প্রোটিন দিয়েই সার্স-কোভ-২ ভাইরাস দেহকোষের ভিতর প্রবেশ করে থাকে। ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করার জন্য একটি ভ্যাকসিন যদি এই কৌশল কাজে লাগিয়ে থাকে, অন্যান্য ভ্যাকসিনও সম্ভবত তাই করবে। ফাইজারের ভ্যাকসিনে প্রথমবারের মতো একটি সম্ভাবনাময় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ভ্যাকসিনই ভাইরাসের প্রোটিনে জড় বা নিষ্ক্রিয় অংশ ঢুকিয়ে দিয়ে ইমিউন ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে। ফাইজারের এই ভ্যাকসিন আরএনইর একটি রূপে থাকা জিনেটিক ইনস্ট্রাকশন শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে খোদ শরীরকে দিয়েই ভাইরাসের প্রোটিন তৈরি করায়। আরএএনকে যেহেতু সম্পাদনা করা সম্ভব তাই স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশন ঘটলে ভ্যাকসিনকেও সে অনুযায়ী সামঞ্জস্য বিধান করা যেতে পারে। এ প্লাটফর্মকে অন্যান্য ভাইরাস ও অন্যান্য রোগ এবং সম্ভবত ক্যান্সার দমনের কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ করে ফাইজার জানায় যে তাদের ভ্যাকসিন ভাইরাসের সংক্রমণরোধে এমনকি বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ৯৫ শতাংশ কার্যকর। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর কোন উদ্বেগের কারণ নেই। বয়স, জাতি ও নৃতাত্ত্বিক জনমিতির ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার সামঞ্জস্য রয়েছে। ৬৫ বছরের বেশি ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯৪ শতাংশের বেশি। ফাইজারের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় অংশ নেয়া ভলান্টিয়ারদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ১৭০টি কেস চিহ্নিত করে। এর মধ্যে ১৬২টি সংক্রমণ ঘটে প্লাসিবো বা স্রেফ স্যালাইন দেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এবং প্রকৃত ভ্যাকসিন পাওয়া ৮ জনের ক্ষেত্রে। এই হিসাবের ভিত্তিতে ফাইজার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৯৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফাইজারের পর আরেক সুখবর দিয়েছে মার্কিন কোম্পানি মডার্না। কোম্পানি জানিয়েছে যে শেষ ধাপের পরীক্ষার প্রাথমিক যেসব তথ্য প্রমাণ মিলেছে তাতে দেখা যায় এই ভ্যাকসিন করোনা প্রতিরোধে শক্তিশালী সুরক্ষা দিতে পেরেছে। তাদের এমআরএনএ-১২৭৩ ভ্যাকসিন ৯৪.৫ শতাংশ কার্যকর। ভাইরাস নিয়ে যারা কাজ করছে তাদের অধিকাংশ মনে করে যে ভ্যাকসিনের ৭০ শতাংশ কার্যকারিতা থাকলেই ভালো। ৫০ শতাংশ কার্যকারিতা থাকলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। ৯০ শতাংশের বেশি হলে তো আর কথাই নেই। এসব খবরে করোনা ভারাক্রান্ত নেতিয়ে পড়া বিশ্বে একটা চাঙ্গার ভাব দেখা দিচ্ছে। এর প্রভাব অর্থ বাজারে গিয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা করোনা সঙ্কটে লাভবান হওয়া টেক ফার্মগুলোর শেয়ার দেদার কিনে সেগুলোর বাজার গরম করে ফেলেছিল। এখন তারা অন্যান্য ফার্মের দিকে ঝুঁকছে। ওইসিডির হিসেবে ভ্যাকসিন শীঘ্রই পাওয়া গেলে ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। ফাইজার ও মডার্নার ঘোষণার আগে রাশিয়া ও চীন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পরিধির বাইরে কিছুকাল ধরে তাদের কিছু নাগরিককে করোনার টিকা দিয়ে আসছে। গত ১১ নবেম্বর রাশিয়ান ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ঘোষণা দেয় যে রাশিয়ার ভ্যাকসিন স্পুটনিক৫- ৯২ শতাংশ কার্যকর বলে তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে। চীনের দিক থেকে এখনও সেরকম কোন ঘোষণা আসেনি। ফাইজার ও মডার্নার ঘোষণার আগে রাশিয়ার ঐ দাবিকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছিল। এখন আর তেমন মনে হচ্ছে না। টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নির্ণয়ে আমেরিকার এফডিএ এবং ইউরোপিয়ান মেডিক্যাল এজেন্সি যেসব কঠোর বিধিনিয়ম বেধে দিয়েছে চীনÑ রাশিয়ার টিকাগুলোকে সে ধরনের কঠোর বিধিনিয়মের ধাপ পাড়ি দিতে হয়নি এবং হয়ও না। যা হোক ফাইজার ও মডার্নার পর আরও আশার কথা আছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কর্মরত অস্ট্রাজেনেকা নামে একটি ওষুধ কোম্পানি এ বছর শেষ হবার আগেই তার টিকার চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করার কথা। তারপরও চ্যালেঞ্জ থাকছে। ভ্যাকসিনের ওপর আস্থা কোনভাবেই যাতে খর্ব না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে যেমন অনেক কিছুই করতে হবে, তেমনি আবার বিপুল জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞও চালাতে হবে। টিকা উৎপাদন ও নজিরবিহীন পরিসরে তা বিতরণের পরিকল্পনা কয়েক মাস ধরে বিশ্বজুড়ে নেয়া হয়েছে। তবে সেগুলো সংশোধন করারও দরকার হতে পারে। কারণ নানা ত্রুটিবিচ্যুতি বের হতে পারে। সবকিছু যদি ঠিকও থাকে তারপরও ঠিকা দেয়া লোকের সংখ্যা আগামী কয়েক মাস ধরে অল্পই থেকে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, করোনা ঠেকানোর টিকা তো বের হয়েছে শেষ পর্যন্ত। কথা হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনার টিকা বের করাটা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এর জন্য প্রচুর পরিশ্রম যেমন করতে হয়েছে তেমনি ব্যবহৃত হয়েছে নতুন প্রযুক্তি। মানের সঙ্গে কোনরকম আপোস না করে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত করতে হয়েছে। প্রযুক্তির কথাই আগে বলা যাক। ভাইরাস রোধের ভ্যাকসিনের ভিত্তি এতদিন ছিল ভাইরাসের অংশ যেগুলো ক্ষয়ে এমন দুর্বল হয়ে গেছে যে তা থেকে রোগ হবে না। আবার কিছু কিছু থাকত স্বাভাবিক ভাইরাসের কণা যেগুলো এমনভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছে যে সেগুলো আর মোটেও প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। আজ ভাইরাসের জেনোমের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে গবেষকরা একটা জিনের সন্ধান করেন সেখানে প্রোটিনের এমন বর্ণনা থাকে যে দেহের ইমিউন ব্যবস্থা সেটাকে চিনতে পারে। তারপর তারা সেই জিনকে নতুন পটভূমিতে স্থাপন করেন। সার্স-কভ-২ অর্থাৎ যে ভাইরাস থেকে কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি তার জেনম প্রকাশিত হয় গত ১০ জানুয়ারি। এর ভিত্তিতে গবেষকরা কাজ শুরু করে দেন। তারা ভাইরাসের পর্দার গায়ে সেটে থাকা স্পাইক প্রোটিনের ওপর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং ধরে নেন এ প্রোটিনই যতসব নষ্টের গোড়া। জার্মান জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেক ‘মারনা’ ব্যবহারে বিশেষ দক্ষ। ‘মারনা’ হলো জিনেটিক মেটেরিয়ালের সিকোয়েন্স যা দেহকোষগুলোকে প্রোটিন তৈরির রেসিপি যোগায়। স্পাইক প্রোটিন তৈরির রেসিপিও মোটামুটি এই রকম। কোম্পানির গবেষকরা সেই স্পাইক প্রোটিনের রেসিপির একটা ‘মারনা’ সংস্করণ তৈরি করেন যা লিপিড দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র ক্যাপসুলের মধ্যে করে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। সেখানে গিয়ে সেটি দেহকোষগুলোকে দিয়ে স্পাইক প্রোটিন তৈরি করায় এবং ইমিউন সিস্টেমও তখন সেটা লক্ষ্য করে সেটিকে প্রতিরোধের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর আগে আর কখনই মানবদেহে মারনা ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়নি। মডার্না কোম্পানিও ‘মারনা’র পথ অবলম্বন করেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অন্য পথে অগ্রসর হন। তারা স্পাইক জিনের একটি সংস্করণ নির্দোষ প্রকৃতির এডিনোভাইরাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। এডিনোভাইরাস মূলত বানরের দেহে পাওয়া যায়। যাই হোক স্পাইক জিন এডিনোভাইরাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার ফলে সেই ভাইরাসটি তখন দেহকোষগুলোকেও সংক্রমিত করে এবং দেহকোষগুলো স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে থাকে যা ইমিউন সিস্টেমের নজর কেড়ে নেয়। জনসন এ্যান্ড জনসন কোম্পানিও এই এডিনোভাইরাসের পথেই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনটিও এই একই কৌশলে তৈরি। এসব অভিনব কৌশলের ভিত্তিতেই যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করা গেছে সেটা কোন আকস্মিক ঘটনাচক্রের ব্যাপার নয়। করোনা আঘাত হানার আগেই এই প্রযুুত্তিগুলো উদ্ভাবন করা হচ্ছিল যাতে ভাইরাসঘটিত নতুন কোন রোগ দেখা দিলেই দ্রুত মোকাবেলা করার জন্য এই প্রযুক্তিকে প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফাইজারের ভ্যাকসিনের ইতিবাচক ফল থেকে এই সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে যে অন্যান্য কোম্পানির কোভিড ভ্যাকসিনও সফল হবে। যে ভ্যাকসিন তৈরি করতে ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যাওয়ার কথা ছিল তা এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বের করা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাকসিন তৈরির কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য নতুন প্লাটফর্মও যদি সফল হয় তাহলে ভ্যাকসিন বিজ্ঞানের রূপান্তর ঘটে যাবে। আরও অনেক ভ্যাকসিন আসার পথে আছে এই কথাটা বেশ কটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণ হলো ফাইজার যদিও সুখবর দিয়েছে তথাপি তাদের ভ্যাকসিন অনুমোদন পাবেই এখনও পর্যন্ত তার কোন নিশ্চয়তা নেই। টিকাটি যে মানবদেহের জন্য নিরাপদ সে ব্যাপারে আরও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। ফাইজার যদিও বলেছে যে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলাকালে নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুতর কোন বিষয়ের উদ্ভব হয়নি তথাপি অন্তত কারও কারও ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এ অবস্থায় কোম্পানি জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োগের জন্য ভ্যাকসিনের অনুমোদন চাইবে। এরপর প্রশ্ন আসে ভ্যাকসিন ঠিক কি কাজ করবে? এটি কি সংক্রমণ সম্পূর্ণরূপে রোধ করবে নাকি শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে স্রেফ জোরদার করে তুলবে? প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ভ্যাকসিন যদি করোনা রোগ ঘটাতে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমায় তাহলে যাদের এ রোগ হবে তাদের রোগের তীব্রতা কম হবে। ভ্যাকসিন যদি রোগ দমন করে কিন্তু সংক্রমণ দমন না করে তাহলে ভ্যাকসিন নেয়া লোকেরা নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারলেও অন্যদের সংক্রমিত করতে পারবে। ফাইজারের ভ্যাকসিন যদি নির্বীজন করার মতো ইমিউনিটি না দিতে পারে সেক্ষেত্রে ঐ ধরনের ইমিউনিটি দেয়ার মতো টিকার প্রয়োজনীয়তা থাকবে। অন্যান্য কারণেও পরবর্তী ভ্যাকসিনগুলো বাঞ্ছনীয় বলে প্রমাণিত হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কম বা বেশি কাজ করতে পারে। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এমন এক ভ্যাকসিন খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুড়ো মানুষদের ক্ষেত্রেও ভাল কাজ করতে পারে। তাদের ইমিউন ব্যবস্থা এমন যে অনেক সময় তা ভ্যাকসিনেও সাড়া না দিতে পারে। তাদের বেলায় এমন ভ্যাকসিন ভাল কাজ দিতে পারে যা সাধারণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অতটা কার্যকর না দেখায়। সেরা ভ্যাকসিনটি সার্বিকভাবে বয়স্কদের জন্যও সর্বোত্তম হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। ফাইজারের ভ্যাকসিনের কিছু অসুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যও আছে। এই ভ্যাকসিন যেখানে তৈরি হয় সেখান থেকে যেখানে ওটা ব্যবহৃত হবে সেখানে তা মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বা তার চেয়েও ঠাণ্ডায় রাখতে হবে। এর জন্য বেশ কিছু সাজসরঞ্জাম দরকার যা অন্যান্য ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে দরকার হয় না। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো ব্যবস্থা বর্তমানে অনেক দেশেরই নেই। তবে এই ঘাটতি অনতিক্রম্যও নয়। ইবোলা ভ্যাকসিনের জন্যও একই রকম বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। কঙ্গো সাফল্যের সঙ্গে এই ব্যবস্থা করতে পেরেছে। ব্যবস্থাটা ব্যয়বহুল তবে সম্ভব সাধ্য। ফাইজার, মডার্না, অস্ট্রাজেনেকার টিকাগুলো কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটো ডোজে দিতে হবে। জনসন এ্যান্ড জনসন যে টিকা বের করতে যাচ্ছে আশা করা হচ্ছে সেই টিকার মাত্র এক ডোজেই কাজ হবে। এতে টিকাদান কর্মসূচী অনেক সহজতর হবে। এক ডোজেই যদি কাজ হয় তাহলে অধিকতর সংখ্যক মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনা যাবে। এসবের ওপর কথা হলো টিকার দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ফাইজার বায়োএনটেক বলেছে তাদের টিকা অন্তত এক বছর সুরক্ষা দিতে পারবে। তবে চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে পূর্ণ অনুমোদন পাওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার আগ পর্যন্ত তা নিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই। অল্প দিনের সুরক্ষা দেবে এমন ভ্যাকসিন ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তারে তেমন একটা ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না। ফাইজার, মডার্না, অস্ট্রাজেনেকার টিকা যদি জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয় সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এসব ভ্যাকসিনের ব্যবহার সীমিত করবে। প্রথম দিকে সেই সব ব্যক্তিদের এই টিকা দেয়া হবে যারা মৃত্যু বা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তারপরও তাদের ক্ষেত্রে এই টিকার ফলোআপ কয়েক বছর ধরে চালাতে হবে। ভ্যাকসিন ব্যাপক পরিসরে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হলে বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই-চেইনের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। সব কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা তো এক নয়। ফাইজার বলেছে ২০২০ সালে তারা আড়াই কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার মতো ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হবে, তার বেশি নয়। পরের বছর ১৩০ কোটি ডোজ পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব যা দিয়ে আরও ৬৫ কোটি লোককে টিকা দেয়া যেতে পারে। অন্যান্য ভ্যাকসিন যদি অনুমোদন পায় তাহলে টিকার সরবরাহ বাড়বে। সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক চিত্রটাও যদি ধরা হয় সেক্ষেত্রে ২০২১ সালের গোটা অধ্যায় জুড়ে টিকার চাহিদা সরবরাহের চাইতে বেশি থাকবে। বিভিন্ন দেশ টিকা উদ্ভাবনকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে ক্রয়চুক্তি করেছে। সিইপিআই, জিএভিআই ও ডব্লিউএইচও মিলে গঠন করেছে কোভাক্স নামে এক সংস্থা যা ১৫০টি দেশের জন্য ভ্যাকসিন কিনবে এবং ২০২১ সালের মধ্যে এই দেশগুলোর ২০ শতাংশ লোককে যাতে টিকা দেয়া যায় তার জন্য পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সংগ্রহ করবে। ইউনিসেফ টিকা বিতরণে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নেবে। প্রতিবছর ইউনিসেফ শিশুদের রুটিন টিকাদান কার্যক্রমের জন্য ৬০ কোটি থেকে ৮০ কোটি সিরিঞ্জ সংগ্রহ করে থাকে। কোভিডের চাহিদার কারণে এই সংখ্যা তিনগুণ বা চারগুণ বাড়তে পারে। প্রথমদিকে টিকা দেয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তিনটি অগ্রাধিকার গ্রুপকে চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়েছে। যেমন অগ্রসারীর স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা কর্মী, ৬৫ বছর বয়োসোর্ধ ব্যক্তি, ডায়াবেটিসের মতো রোগ আছে এমন ৬৫ বছরের কম বয়সী ব্যক্তি। এরা বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। টিকাদান ব্যাপক পরিসর লাভ করার পরও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হিসেবে থেকে যাবে। জীবনযাত্রা অধিকতর স্বাভাবিক রূপ ধারণ করতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। টিকাদান কার্যক্রম ভালভাবে কাজ করতে হলে টিকা নেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ থাকা দরকার। কথাটা উঠছে এই জন্য যে টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচারও কম হচ্ছে না। তারপরও এই ক্ষেত্রে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে সেটা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। ২৭টি দেশে ২০ হাজার প্রাপ্ত বয়স্কের ওপর জরিপ চালিয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। তাতে দেখা যায় ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে তা নিতে ৭৪ শতাংশ লোক আগ্রহী। চীনে এমন লোকের সংখ্যা ৯৭ শতাংশ, ভারতে ৮৭ শতাংশ, আমেরিকায় ৬৭ শতাংশ। টিকা নিতে আগ্রাহী লোকের সংখ্যা কম এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া ৫৪ শতাংশ, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরী উভয় দেশে ৫৬ শতাংশ এবং ফ্রান্স ৫৯ শতাংশ। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×