ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

মানবিক শিক্ষার সামাজিকীকরণ

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২২ নভেম্বর ২০২০

মানবিক শিক্ষার সামাজিকীকরণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রার্থনা’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি নিবন্ধের সূচনায় নিবেদন করতে চাই- ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়/অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়’। উল্লেখ্য, উপস্থাপনার নিগূঢ় বিশ্লেষণে মানবিক শিক্ষার উপযোগিতা ও প্রাসঙ্গিকতা স্বরূপে উন্মোচিত। অনানুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিশীলিত-পরিমার্জিত মানব সভ্যতার কল্যাণধর্মী সোপান নির্মাণ। সামগ্রিক গণমুখী মঙ্গল সাধনে অর্জিত শিক্ষা পরিশুদ্ধ জ্ঞানে রূপান্তরিত না হলে শিক্ষার অর্থবহতা বিরূপ ব্যঞ্জনা তৈরি করবে। দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং নিজের অস্তিত্বকে সার্থক আবিষ্কারে শিক্ষা নবতর জ্ঞান সৃজনে প্রণিধানযোগ্য উপাদান হিসেবে সবত্রই আভাষিত। প্রকৃত শিক্ষার প্রাথমিক উৎসস্থল হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ-দল মত-অঞ্চল-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। পরিবার-প্রতিবেশ-সামাজিক পরিবেশ এবং আবহমান কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, বংশপরাম্পরায় ব্যবহারিক-আচরণগত অনুশীলন ও পরিচর্যার ত্রৈকালিক বিমোহন অভিযাত্রাই সর্বজনস্বীকৃত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ। উক্ত পর্যায়ে শিশু-কিশোর-তরুণদের শিক্ষা-কার্যক্রমের পটভূমিতে প্রত্যাশিত জাতি-রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ ত্যাগ-তিতিক্ষা-অর্জন-বিসর্জনের বিস্তৃত ইতিহাস। উপলব্ধিতে ছন্দোবদ্ধ করতে হবে; জাতীয় পতাকা-জাতীয় সঙ্গীত-দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম-মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষচিত অরুন্তুদ তাৎপর্য। যথাযথ মর্মার্থ অনুধাবনে ব্রতী হতে হবে বাংলার খ্যাতিমান কবি সৈয়দ শামসুল হক রচিত কবিতার। কবি ‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ কবিতায় লিখেছেন ‘দশ লক্ষ ধর্ষিতার আর্তনাদে যখন নষ্টমান আমার শ্রুতি,/ তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তে যখন প্লবমান আমার স্মৃতি,/ তিন কোটি মানুষের গৃহত্যাগে যখন বিলীয়মান আমার সভ্যতা,/ বলীবর্দের দ্বিখণ্ডিত খুরে যখন কম্পমান আমার স্বপ্ন,/ যখন এই বর্তমান, এই শ্রুতি, এই স্মৃতি, এই সভ্যতা, এই স্বপ্ন/ এত দীর্ঘকাল আমি একা আর বহন করতে পারছি না...।’ এই করুণ আর্তনাদের প্রতিধ্বনি সকলের হৃদয়ে অনুরণিত না হলে দেশপ্রেমের পরিপ্রেক্ষিত সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে না। এটি সর্বজনবিদিত যে, পৃথিবী নামক এই গ্রহে অদ্যাবধি অনগ্রসর থেকে অগ্রসরমানতার বিনিয়োগ ছিল শিক্ষা। শিক্ষার আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, জ্ঞানসৃজনে সমৃদ্ধ গবেষণা, মেধাসম্পন্ন যোগ্যতর শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার যথার্থ নৈর্ব্যক্তিক পর্যালোচনা ব্যতিরেকে গুনগত মানবিক শিক্ষার বাস্তবায়ন সমধিক কল্পনাপ্রসূত। জীবনপ্রবাহের আদি অনুষঙ্গ; ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-নীতি নৈতিকতা-শুদ্ধাচারের শিক্ষাকে ন্যূনতম অবজ্ঞা করে আধুনিক শিক্ষার আবরণে প্রতারণা-মিথ্যাচার-কদাচার-পাপাচার ইত্যাদি ঘৃণ্য অপশিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা শুধু অপরাধ নয়; কদর্য পাপ হিসেবেও নির্ণীত। এজন্যই জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানবিক শিক্ষার উন্নততর ক্ষেত্র তৈরিতে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে অবশ্যই সর্বাধিক প্রধান্য দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে অতীতের সামাজিক উত্তরাধিকার ধারায় অর্জিত সকল মার্জিত-শৃঙ্খলিত-নান্দনিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বংশপরম্পরায় প্রবাহমান পন্থাই হলো সামাজিকীকরণ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে কোন শিশুকে উল্লিখিত আদর্শিক সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচলিত মূল্যবোধ-রীতিনীতি এবং নৈতিক-আদর্শিক ভাবনা-ধারণায় প্রমোদিত করা সমাজের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। পরিবেশ-প্রতিবেশ ভিত্তিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা, পরিবারের প্রতি আনুগত্য ও দায়িত্ব এবং মাঙ্গলিক চরিত্র গঠনের দীক্ষাই হবে এই পর্যায়ের জ্ঞান-প্ররোহ। এরই অনুকরণ-প্রতিপালনে আজীবন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা এবং আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-যুগোপযোগী দীপন অন্বেষণে সামাজিকীকরণ ধারার প্রতিফলন অনস্বীকার্য। বিজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। অনেকের মতে, ‘Socialization is the process through which people come to want to do what they must do. That is, a society has patterns and traditions that can survive only if its new members learn and accept them. But through socialization people acquire not only culturally prescribed needs and motivations but also many other aspects of personality. They acquire language, knowledge and skills, commitment to particular norms and values, and the ability to perform in many role relationships.’ (M. Spencer I A. Inkeles)) মূলত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মানসিক-জৈবিক-পারিপার্শ্বিক, প্রায়োগিক আচার-আচরণ-ব্যবহার, সৌহার্দ-সম্প্রীতি, মননশীলতা-সৃজনশীলতা-অসাম্প্রদায়িকতাসহ মানবিকতার পরিশুদ্ধ-সঙ্গত-সংযত শিক্ষণ পাঠোদ্ধারে ঋদ্ধ হয়। প্রসঙ্গত, ভারতবর্ষের অন্যতম আলোকবর্তিকা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত অমিয় বাক্যগুলো স্মরণ করা যেতে পারে- ‘সদা সত্য কথা কহিবে। যে সত্য কথা কয়, সকলে তাহাকে ভালবাসে। যে মিথ্যা কথা কয়, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না, সকলেই তাহাকে ঘৃণা করে’, ‘আমি যে সময়ে যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। এজন্য বাবা আমাকে ভালবাসেন। আমি তাঁর কাছে যখন যা চাই, তাই দেন। যদি আমি এখন, পড়িতে না গিয়া, তোমার সহিত খেলা করি, বাবা আমাকে আর ভালবাসিবেন না।’ বিশ্বখ্যাত বরেণ্য জ্ঞানসাধকসহ প্রায় সকল মনীষীর পথচলা ও পথ প্রদর্শন পরিক্রমায় শিক্ষাই ছিল অতীন্দ্রিয় পাথেয়। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ এই প্রচলিত প্রবাদবাক্য শুধু বাচনিক প্রকরণে নয়, প্রদেয় বিবেচনায় সর্বকালেই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল। শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করতে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী J. Ferrante বলেছেন, ‘in the broadest sense, education includes those experiences that stimulate thought and interpretation or that train, discipline, and develop the mental and physical potentials of the maturing person.’ খ্যাতিশীর্ষ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শিক্ষার ধরন ও প্রকৃতি-পরিধি ভিন্ন ব্যক্তির জন্য ভিন্ন পরিবেশ তৈরি করতে পারে। শিক্ষার বিশ্বস্বীকৃত প্রতিপাদ্য কার্যক্রম হচ্ছে- সমাজ-সভ্যতার ইতিবাচক উত্তরণ, সকল ব্যক্তি-সম্প্রদায়-জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে অনন্য সামাজিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধকরণ, জাতীয় পরিচয়-চরিত্র গঠনের নিষ্কলুষ চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণ, সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ, জাগতিক জীবনের প্রবেশে কর্মযোগীর পর্যাপ্ত বিচিত্র দক্ষতা অর্জনে প্রস্তুতি গ্রহণ, আত্মমর্যাদা-আত্মসম্মান-আত্মনির্ভরশীলতার নৈতিকতা-মূল্যবোধ নির্ধারণ ইত্যাদি। আধুনিক জ্ঞান সভ্যতার কিংবদন্তি অবেক্ষক দর্শনশাস্ত্রের জনক মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতানুসারে মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদ বাইরের আবরণ মাত্র। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত জ্ঞান। তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞানই সর্বোত্তম গুণ’, ‘জ্ঞানই শক্তি’। শিক্ষা ও জ্ঞানের নিগূঢ় বিভাজন গর্বিত উপলব্ধিতে আনা না হলে প্রত্যয় দুটির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যে শিক্ষা অন্যের কষ্টে বা অন্য-হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিজের বিবেককে তাড়িত ও বোধকে বেদনাকাতর না করে, সে শিক্ষা কখনও জ্ঞানে অনুসৃত হয় না। সক্রেটিস মূলত সত্যাশ্রয়ী জ্ঞানের প্রকৃত ধারক ছিলেন বলেই মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা অধিকতর শ্রেয় মনে করেছেন। এই সত্য-প্রচার অপরাধেই তাঁকে হেমলক গাছের ভয়ানক বিষাক্ত রস-বিষ পানে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। আমাদের অনেকেরই হয়ত জানা যে, মহান জ্ঞানসাধক ডায়োজীনিস জ্ঞান অনুসন্ধানে জীবনে কখনও বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করেননি। জ্ঞানের আরেক মহানসাধক এরিস্টটল সম্পর্কে মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের জন্য হয়ত আমি আমার জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু এরিস্টটল’। ভারতের জাতীয় ভাবধারার কালোত্তীর্ণ প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় বাল্যকাল থেকে শিক্ষা অর্জনকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং গবেষণালব্ধ সন্ধুক্ষণের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের প্রচলিত সাকার উপাসনা বা মূর্তিপূজাকে অস্বীকার করে বই রচনা করার জন্য পিতা কর্তৃক পরিবার পরিত্যক্ত হন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদি জনক হিপোক্র্যাটিসের অমর বাণী ছিল- ‘জীবন খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শিক্ষা দীর্ঘতর। সুদিন চলে যাচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বিপজ্জনক এবং বিচার বিবেচনা করাও খুব কঠিন কাজ। তবুও আমাদের তৈরি থাকতে হবে, সে শুধু আমাদের নিজের সুখের জন্য নয়, অপরের জন্যও।’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারতবর্ষে শিক্ষাকে জ্ঞান অর্জনের পথে নয়; বরং শাসকগোষ্ঠীর হীনস্বার্থ চরিতার্থে লুম্পেন কর্মকর্তা-কর্মচারী তৈরি ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। ঔপনিবেশিক আমলে শাসক-শোষকদের কুআদর্শ ও কুনীতির সমর্থনে অবিচল থাকার মানসিকতা সৃষ্টি করা ছিল ব্রিটিশ শিক্ষানীতি ও ভূমি ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। ১৮৩৫ সালে ইংরেজী শিক্ষা প্রচলনের পক্ষে টমাস ব্যারিংটন মেকলের বক্তব্যে এটি সুস্পষ্ট যে, শুধু চাকরি-আমলা সৃষ্টি-ব্রিটিশ শাসনযন্ত্র সচল রাখার জন্য বিভিন্ন স্তরের কর্মসংস্থান তৈরির মূল পরিকল্পনা। অবশ্যই জনশিক্ষার প্রসার বা দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নয়। মেকলের ভাষায়- ‘We must at present do our best to form a class who may be interpreter between us and the millions whom we govern; a class of persons, indian in blood and colours but english in taste in opinion in moral, and in intellect.’ মনীষী কার্ল মার্কস শিক্ষার মূল লক্ষ্য হিসেবে উৎপাদনশীল শ্রমের সঙ্গে কায়িক ও মানসিক শ্রমের সংযুক্তি সাধনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ বিকশিত মানুষ সৃষ্টির বিষয়টিকে শিক্ষার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাম্য- মৈত্রীর বন্ধনে মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ-বৈষম্যবিহীন অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই শিক্ষার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য অন্তর্নিহিত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতায় ‘গাহি সাম্যের গান - মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি’, ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় ‘গাহি সাম্যের গান-/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।/গাহি সাম্যের গান!’ উচ্চারণে অত্যুজ্জল উপমায় যে মানবিকতার জয়গান প্রকাশ করেছেন, তারই আলোকে শিক্ষা কার্যক্রমকে সাজিয়ে শিক্ষার্থীদের বোধের গভীরে মনুষ্যত্ব-মানবিকতা প্রোথিত করতে হবে। মহীয়সী রমনী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মানবতাবাদী দর্শনের চর্চায় আমাদের শিক্ষার্থীদের গৌরবোজ্জ্বল হতে হবে। তিনি বলেছিলেন- ‘একজন ধর্ম-পিপাসু ব্যক্তি জনৈক দরবেশের নিকট যোগ শিক্ষা করিতে চাহিল। তাহাতে দরবেশ বলিলেন, ‘চল আমার গুরুর নিকট।’ সে গুরু একজন হিন্দু। হিন্দু সাধু বলিলেন, ‘আমি কি শিখাইব, আমার গুরুর নিকট চল।’ তাঁহার গুরু আবার একজন মুসলমান দরবেশ! শিক্ষার্থী দরবেশকে এই হিন্দু-মুসলমানে মেশামিশির কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন- ধর্ম একটি ত্রিতল অট্টালিকার ন্যায়। নিচের তলে অনেক কামরা, হিন্দু-ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যদি বিভিন্ন শাখা; মুসলমান-শিয়া, সুন্নি, হানাফী, সালাফী প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়; ঐরূপ খ্রীস্টান, রোমান-ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট ইত্যাদি। তাহার উপর দ্বিতলে দেখ, কেবল মুসলমান-সবই মুসলমান; হিন্দু সবই হিন্দু সবই হিন্দু, ইত্যাদি। তাহার উপর ত্রিতলে উঠিয়া দেখ, একটি কক্ষ মাত্র, কামরা বিভাগ নাই, অর্থাৎ মুসলমান, হিন্দু, কিছুই নাই- সকলে একপ্রকার মানুষ এবং উপাস্য কেবল এক আল্লাহ। সূক্ষ্মভাবে ধরিতে গেলে কিছুই থাকে না-সব ‘নাই’ হইয়া কেবল আল্লাহ থাকেন।’ (রোকেয়া রচনাবলী) অকস্মাৎ অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় অর্থ-বিত্ত-সম্পদ উপার্জন, ক্ষমতা-আধিপত্য-দুর্বৃত্তায়নের মোড়কে মেধা-অর্থ-বাণিজ্য পাচারের কূটচাল ও কলুষিত বশংবদদের নষ্ট পৃষ্ঠপোষকতায় তথাকথিত ইংরেজী শিক্ষা প্রসারের সরকার-বেসরকারী স্বীকৃতি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা বাংলার অধিকতর সম্প্রসারণ, বাঙালীর সাবলীল-শাশ্বত-অপরূপ কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে আড়াল করার কুৎসিত অপপ্রয়াসকে বিনাশ করে দেশ ও জাতির সুনাম ও ভাবমূর্তিকে সমুজ্জ্বল রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজীবন মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাসীন করে বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতিকে ধারণ-লালন-পালনের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এই নির্দেশনার আলোকে স্বজাত্যবোধের অহংকারে গর্বিত হয়ে মানবিক শিক্ষার সামাজিকীকরণকে প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সুদৃঢ় ও সুনিশ্চিত করা না হলে জাতির সকল গৌরবদীপ্ত অর্জনের আলোকিত পথকে রুদ্ধ করে অপশক্তির ঘৃণ্য সহযোগী ও কুশীলবরা অন্ধকারের অশুভ দেয়ালকে পুনঃস্থাপন করতে সংশয়বোধ করবে না- এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×