ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ফারুক হোসেন

করোনা ও অন্যান্য বর্জ্যে দূষিত রাজধানীর পরিবেশ

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২১ নভেম্বর ২০২০

করোনা ও অন্যান্য বর্জ্যে দূষিত রাজধানীর পরিবেশ

সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে পুরো বিশ্ব। পৃথিবীজুড়ে ফের বাড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপ। আমাদের দেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বিশ্বে এই ভাইরাসে ৫ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে গত এক মাসে এই ভাইরাসে শনাক্ত হয়েছে এক চতুর্থাংশ। করোনা বর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্যরে কারণে দূষিত হতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকার পরিবেশ। পাশাপাশি এডিস মশার উপদ্রবও বেড়েছে। বেড়েছে রাজধানীর বায়ু দূষণের মাত্রাও। রাজধানীতে যত্রতত্র মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, হেড কভার, সু-কভার, গগলস, ফেসশিল্ড-গাউনসহ যেসব সুরক্ষা সামগ্রী সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছেন, এর একটা বড় অংশ রাস্তা-ঘাটে উন্মুক্ত জায়গায় ফেলে দেয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বলা হচ্ছে, ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় সুরক্ষাসামগ্রীতে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত করোনাভাইরাস টিকে থাকতে পারে। করোনার কারণে দেশে ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে গত ৩০ মে থেকে। এর আগে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়ে ৫ জুন নির্দেশিকা হালনাগাদ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মাস্ক পরা। জীবন বাঁচাতে এর বিকল্পও নেই। এসব সুরক্ষা সামগ্রী তথা কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে রাজধানীতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। করোনা সুরক্ষাসামগ্রী প্লাস্টিকের তৈরি যা একবার ব্যবহারযোগ্য, এসব পণ্য ভূমিতে বা পানিতে সাড়ে চারশ’ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাই মাস্ক-প্লাস্টিকের তৈরি অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ভূমি, নর্দমা, নদী ও সমুদ্র দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে। সাধারণ বর্জ্যরে মতো যখন করোনা বর্জ্য উন্মুক্তভাবে পোড়ানো হয় তখন মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের টিকা বা বিকল্প কোন সমাধান না আসা পর্যন্ত মাস্ক-অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী মানুষকে ব্যবহার করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কি পদক্ষেপ নেয়া হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত চিকিৎসা বর্জ্যরে মাত্র ৬ দশমিক ৬ ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। বাকি ৯৩ দশমিক ৪ ভাগ বর্জ্যই সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি পরিচালিত কোভিড-১৯ মহামারীকালে কার্যকর মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও শীতকালে সংক্রমণ বৃদ্ধির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানান, ‘আসন্ন শীত মৌসুমে যাতে করোনা বাড়তে না পারে, সেজন্য নো মাস্ক-নো সার্ভিস নীতি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দেশের পয়েন্ট অব এন্ট্রিগুলোতে স্ক্রিনিং অব্যাহত রয়েছে। বিদেশ ফেরতদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।’ আরও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় শীতে আবাসিক এলাকাগুলো যথাসম্ভব নির্মাণকাজ চালাতে যথাযথ ধুলা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে নির্মাণকাজ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে নিয়মিত পানি ছিটিয়ে ধুলা প্রতিরোধ করতে হবে । বর্জ্য পদার্থ আধুনিক ও নিরাপদ অপসারণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। এসব বর্জ্যরে কারণে পরিবেশ দূষিত হওয়ার মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। শিল্প বর্জ্য, মেডিক্যাল বর্জ্য, প্রাণীজ বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি ইত্যাদি। এর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। পড়ছে জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক জীবনে অতীব জরুরী বিষয়। শহর-নগর সর্বত্র পরিচ্ছন্ন জীবন দরকার। কঠোরভাবে নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখার ও স্বাস্থ্যসম্মত নাগরিক জীবনের জন্য শহরকে যে কোন মূল্যে পরিষ্কার রাখার জন্য এসব ক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি নিজেদেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন অবস্থায় ড্রেনের ময়লা রাস্তায় স্তূপ করে রাখা যাবে না। এসব বিষয়ে পরিচ্ছন্নকর্মীদের তাদের দায়িত্ব পালনে মনিটরিং, সুপার ভাইজারিং রাখতে হবে। যে কোন অবস্থায় শহর জীবন অস্বাস্থ্য দুর্বিষহ দুর্গন্ধময় হয়ে উঠুক সেটা নগরজীবনে কোন সময়েই কাম্য হতে পারে না। শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রাখতে আমাদের বেশকিছু পদক্ষেপের উপর জোর দিতে হবে। এর দ্বারাই আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর বিশুদ্ধ বাতাস এবং পানীয় জলে সমৃদ্ধ একটি শহর গরে তুলতে পারব। রাস্তাঘাট, বাসা-বাড়ি নির্মাণ এবং নগর পরিকল্পনায় সবুজায়নকে প্রাধান্য দিতে হবে। সবুজ ঢাকা গড়ে তুলতে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পিত বনায়ন করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় অবশ্যই পরিবেশকে সর্বোচ্ছ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে নগরায়ণকে করতে হবে পরিবেশবান্ধব। জল, জমি, বায়ু, শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে নিতে হবে শক্ত অবস্থান। শহরের ভেতরে পার্ক, মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান চিহ্নিত করতে হবে যেন জনগণ মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারে। বেদখল পার্ক ও মাঠ উদ্ধার করে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা উপযোগী করতে হবে। এলাকাভিত্তিক জলাবদ্ধতা দূরীকরণে স্থানীয় এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সাপেক্ষে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসণে নিয়মিত এবং বিশেষভাবে বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে। ড্রেন পরিষ্কারে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে হতে প্রতিটি স্থানে। দুর্গন্ধমুক্ত নগরী করতে পর্যায়ক্রমে ময়লার ভাগাড়গুলো (ডাস্টবিন) সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। শহরের ভেতরের লেকগুলোতে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে সব সময় তদারকি করতে হবে ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাগুলোর সৌন্দর্যবর্ধনে কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ তো নে-ই, উপরন্তু সেখানেও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজেদের সচেতন হতে হবে। বাসাবাড়ির আশপাশ, রাস্তা-বাজার, জনসমাগম স্থল, ডোবা, বিভিন্ন স্থাপনার আড়ালে-আবডালে ময়লা ফেলার উৎকৃষ্ট জায়গা হিসাবে বেছে নেয়া হচ্ছে। বাসার সামনে প্যাকেট করে ময়লা রেখে দিলে স্থানীয় কর্মীরা সেটা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা সংগ্রহের ট্রাকে রেখে আসে। এই ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে সব স্থানে এই পদ্ধতি চালু করতে হবে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যারা বসবাস করছেন, তাদের সবার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। ময়লার গন্ধে মশাবাহিত নানা রোগসহ দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ময়লার স্তূপে চরম বিপাকে পড়তে হয় সাধারণ পথচারীদের। বিঘ্ন হয় যান চলাচলেও। অল্প বাতাসে ও বৃষ্টিতে দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা স্তূপ ছড়িয়ে পড়ে সড়কে। এতে এলাকায় যেমন মশার উপদ্রব বাড়ছে তেমনি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ আবর্জনা সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনর্ব্যবহার ও নিষ্কাশনের সমন্বিত ব্যবস্থা জোরদার করে পরিবেশকে সুন্দর ও জীবাণুমুক্ত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। শীত এগিয়ে আসছে, তাপমাত্রাও কমছে। রাজধানীর চারপাশের ইটভাঁটিগুলো চালু হয়েছে। নির্মাণকাজও বাড়ছে। আর এতেই রাজধানীর বাতাসে দূষণ বাড়তে শুরু করেছে। বায়ু দূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতাসে ভারি ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। দেশের বায়ু দূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ু দূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। দূষণের অন্যতম উৎস নির্মাণকাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগও তেমন নেই। আবার রাজধানী ঢাকায় হঠাৎ করে মশার উপদ্রব বেড়েছে। বস্তি থেকে শুরু করে অভিজাত ফ্ল্যাটবাড়িসহ সব জায়গায় সন্ধ্যা নামতে না নামতেই বাড়ছে মশার উৎপাত। মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন নগরবাসীরা। মহামারী করোনাভাইরাস আতঙ্কের সঙ্গে নতুন করে যোগ হচ্ছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। মশা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বছরের পর বছর ধরে মশক নিধনের জন্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও এডিস মশার কারণে যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ঘটে সেই মশা এখন মানুষের কাছে এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×