ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

করোনাকালে রাজস্বপ্রাপ্তি, আয়কর মেলা ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ২১ নভেম্বর ২০২০

করোনাকালে রাজস্বপ্রাপ্তি, আয়কর মেলা ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ

কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা, উত্তরণ এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০২১, এসডিজি ২০৩০ বাস্তবায়ন ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১-এর লক্ষ্য সামনে রেখে যথাক্রমে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে উত্তরণের অনুষঙ্গ হিসেবে যেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি (৮.২%), মূল্যস্ফীতি ৫.৪ শতাংশ, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগের হার ৩৩.৫৪ শতাংশ ইত্যাদি ধরে বর্তমান বছরের বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার; কিন্তু কোভিড-১৯ সঙ্কট উত্তরণ এ বছরই সম্ভব কিনা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্লোবাল ইকোনমিক প্রস্পেকটাস ২০২০ প্রকাশ করেছে। যাতে বলা হয়েছে ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দায় পড়বে বিশ্ব। ৭ থেকে ১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যে পতিত হবে এবং বর্তমান বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৬ শতাংশ হতে পারে। তবে আমরা কিছুটা আশাবাদী হতে পারি যে, যেহেতু গত জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ভাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেহেতু বছর শেষে ৩০ জুন, ২০২০ পর্যন্ত আশাপ্রদ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.২৪%। সেই হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ শতাংশ এবং গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১.৯১ শতাংশ। ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা আর অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। আর জিডিপি আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সাম্প্রতিককালে রাজস্বনীতিতে অনেক সংস্কার সাধন করেছে সরকার। যার মধ্যে কর ব্যবস্থাপনা অন্যতম। যেমন, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, কর আপাতন হ্রাসকরণ, মূসকের পরিধি বৃদ্ধি ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ (উৎস : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড)। এরই মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে আয়কর রহিত সীমা ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা, মহিলা ও সিনিয়র সিটিজেন কর দাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা/প্রতিবন্ধী/উপজাতিদের জন্য করসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ক্ষুদ্র করদাতাদের সুবিধার্থে ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারী কোষাগারে জমা দেয়ার বিধান করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে করদাতাদের সুবিধার্থে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পাশাপাশি আয়কর মেলারও আয়োজন রয়েছে। এসব উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়ার উদ্দেশ্য হলো সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, ঘাটতি বাজেট কমানো ও আয়-ব্যয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা। এখন সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় রাজস্বনীতি কতটুকু প্রভাব রাখছে তা নিয়েই আলোচনা, যা সরকারের গত জুন মাসে মহান জাতীয় সংসদে ২০২০-২১-এর বাজেট উপস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমান অর্থবছরের পাঁচ মাস অতিবাহিত হতে চলছে। এই সময়ে সরকারের প্রকৃত আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশিত না হলেও সরকারের গত জুনের ঘোষিত বাজেটে যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, মোট আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা (যা জিডিপির ১১.৯১%)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর কাঠামো থেকে মোট আয়ের ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআরবহির্ভূত কর কাঠামো থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা, করবহির্ভূত কাঠামো থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকা আসবে। বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা (যা জিডিপির ৫.৫%), উন্নয়ন বাজেট দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ টাকা (যা জিডিপির ৬.৮%) যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) খাতে বরাদ্দ ধরা আছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা (যা জিডিপির ৬.৫%) ও অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা (যা জিডিপির ১.৩%)। এখন প্রশ্ন আসে এই বিশাল অঙ্কের ঘাটতি বাজেট কি উৎস থেকে পূরণ করা হবে? বাজেট ঘোষণায় বলা হয়েছিল, বৈদেশিক সাহায্য থেকে আসবে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা (যা জিডিপির ২.৫%), অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা (যা জিডিপির ৩.৫%), যার মধ্যে ব্যাংকিং উৎস থেকে আসবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা (যা জিডিপির ২.৭%)। এখন আসা যাক রাজস্ব আদায়ের টার্গেটের বিষয়ে, যার সঙ্গে রাজস্বনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি ২০২০-২১ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের বিবরণী (সাময়িক) পর্যালোচনা করি তা হলে দেখা যায় যে, বর্তমান আর্থিক বছরে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৬৩,৭১৩.৭৯ কোটি টাকার টার্গেটের বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৪৯,৯৮৯.৭২ কোটি টাকা (৭৮.৪৬%)। এতে দেখা যায়, এই সময়ে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ৪.১১%, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৩.৯৮ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ছিল ১৩ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। আবার যদি খাতওয়ারি রাজস্বের আহরণ বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখা যায় যে, আমদানি-রফতানি পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে সেপ্টেম্বর, ২০ পর্যন্ত ৭৩.১৮% (লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ৫৮৪৭.৮২ কোটি টাকা), স্থানীয় মূসক থেকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিতের হার একই সময়ে ৭৮.০৮% (লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ৫০৮৫.৬৭ কোটি টাকা) আর আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে সেপ্টেম্বর, ২০ পর্যন্ত ৮৫.০৯% (লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ২৭৯০.৫৭ কোটি টাকা)। গত বছর একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৯৮%, যার মধ্যে কাস্টমসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩২%, মূসক ২.১৩% এবং আয়কর ১২.৩৩%। এনবিআরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক গতি আসছে। তবে ভ্যাট আদায় আগের পর্যায়ে রয়ে গেছে। মহামারীকালে মানুষের আয়-উপার্জন কম হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে, আমদানিও কমে গেছে। তা হলে ট্যাক্স আসবে কোত্থেকে? দোকানপাটে বিক্রি নেই। ফলে ভ্যাট আদায়ও কম। যার প্রতিফলন ঘটেছে কর আদায়ে। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হিসেবে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। সেই হিসেবে অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ১৮ হাজার ১১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রথম ৩ মাসে রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত ভ্যাট আদায়ে ঘাটতি ৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে আয়কর ও আমদানি-রফতানিতে গতি ফিরতে শুরু করলেও বেহাল দশা ভ্যাট আদায়ে। লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে ব্যবসা করলেও ভ্যাট নিবন্ধন রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটির। যার কারণে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেশি হলেও আদায় কম। করদাতাদের অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা নিশ্চিত করার জন্য ইএফডি কার্যক্রম চালুর কথা থাকলেও বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে কার্যক্রম। এতে ভ্যাট আদায়ের গতি ক্রমশ কমছে। এ ছাড়া চেন সুপার শপগুলোর ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে সেলস ডাটা কন্ট্রোল (এসডিসি) বসানোর পরিকল্পনা থাকলেও এই কার্যক্রমে যেতে পারেনি এনবিআর। এছাড়া কাগজে-কলমে হেল্পলাইন চালু হলেও এর অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। একজন ভ্যাটদাতাকে ভ্যাট রিটার্ন দেয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করলে এনবিআর থেকে তাকে পাসওয়ার্ড নিতে হয়। আর হেল্পলাইনে ফোন দিয়ে পাসওয়ার্ড নিতেই নতুন করে করদাতার পরিচয়সহ নানা জটিলতা পোহাতে হয়। এই কারণে অনলাইন ভ্যাট রিটার্নে আগ্রহ নেই অনেকের। ডিজিটাল এনবিআরের লক্ষ্যে ডাটা সেন্টারসহ অনেক প্রকল্প চালু হলেও নির্ভেজাল সেবা পেতে নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয় করদাতাদের। কর আদায়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হলো করমেলা যা বর্তমান বছরে আয়োজনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ করোনা (কোভিড-১৯) মহামারী। অথচ গত বছর এই মেলা ১৪ থেকে ২০ নবেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এক সপ্তাহের এই করমেলায় ৬ হাজার ৪২০ জন করদাতা ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার সমপরিমাণ কর প্রদান করেছে। ১৮ লাখ ৬৩ হাজার করদাতা এই মেলা থেকে সেবা নিয়েছিল, যার মধ্যে কর রিটার্ন জমা দিয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। নতুন ই-টিন নিয়েছে ৩২ হাজার ৯৬১ জন। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দেশের করযোগ্য মানুষ কর দিতে চায়। কিন্তু করবান্ধব একটি নিরাপদ পরিবেশ পায় না, যা বর্তমান সরকার বিগত ২০১০ সাল থেকে চালু করে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এটি এই সরকারের একটি বিরাট সাফল্যই বলা যায়। বর্তমান নীতির ফলে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করের আওতায় এসেছে এবং দেশের শ্রেষ্ঠ করদাতাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। এই পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হলে দেশে করদাতাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়বে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা কমবে ও কর-জিডিপির অনুপাত বাড়বে। আমরা যদি সামষ্টিক অর্থনীতির আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখা যায় যে, রাজস্ব আদায়ে প্রত্যক্ষ করের অংশ বাড়ছে, যা বর্তমান বছরের বাজেটে ধরা হয়েছে ৩৩%। এই পরিমাণ কর সংগ্রহ বর্তমানে কোভিড-১৯-এর কারণে বাধাগ্রস্ত হবে তা সহজেই অনুমেয়। ফলে এই বছর হয়ত সরকারের রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সার্বিক রাজস্ব আদায়ে পরোক্ষ কর যেমন, মূসকের অংশ ৩৭%। দেশে কর-জিডিপির অনুপাত তুলনামূলকভাবে কম হলেও প্রতিবছর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত ১০% থেকে বেড়ে ১৮%-এ উন্নীত হবে। মোট কর রাজস্বে আয়করের অবস্থার ক্রমান্বয়ে উন্নতি হচ্ছে, যা আরও গতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আয়কর আদায়ের হার সমধর্মী অন্যান্য কর শ্রেণীর চেয়ে অনেক অগ্রগামী এবং প্রত্যক্ষ করের প্রাধান্য সব সময় বেশি। এমতাবস্থায় আমাদের রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া কোন গতি নেই। যার জন্য প্রয়োজন ১. করোনা মহামারীর সকল বিধিবিধান মেনে বর্তমান বছরে আয়কর মেলার আয়োজন করা। যদিও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া তা সম্ভব হবে না। ঢাকা শহরসহ দেশের বিভাগীয়/জেলা/উপজেলা শহরগুলোতে যেসব খেলার মাঠ রয়েছে সেগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অনায়াসেই তা করা যায়, যদি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাগণ কঠোর পরিশ্রম করতে সম্মত হন। ফলে দেশের আয়করদাতা ও আয়কর উভয়ই বাড়বে, যা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ২. টিনধারীদের অবশ্যই নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট হারে ফি জমা দিয়ে তা নবায়ন করতে হবে। যারা এই নিয়মবহির্ভূত আচরণ করবে তাদের বিরুদ্ধে আয়কর অধ্যাদেশ আইনে বিচার ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে। অপরদিকে জাতি গঠনে জনগণের প্রদেয় করের যে ভূমিকা রয়েছে তা বিভিন্ন মাধ্যমে বোঝাতে হবে বিস্তারিতভাবে। কর মেলাই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যদি করদাতারা অনুকূল পরিবেশ পায় তবে করের প্রতি তারা কতটুকু সংবেদনশীল। ৩. অন্য বছরের মতো এ বছরও শ্রেষ্ঠ করদাতাদের পুরস্কৃৃত করার ব্যবস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড করতে পারে, যা স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে করা হয়েছে। এতে ভাল করদাতারা উৎসাহিত হবে এবং করোনার সময় ভার্চুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে অনুষ্ঠান করে প্রধানমন্ত্রী করদাতাদের হাতে একটি সুবিধাজনক সময়ে এই পুরস্কার তুলে দিতে পারেন। ৪. সরকারের রাজস্ব নীতিমালার সঙ্গে আয় ও ব্যয়ের বিষয়টি জড়িত বিধায় এখানে সরকারের ব্যয় দক্ষতার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সহায়ক পরিবেশ সুজনের মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, ভৌত অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার বাজেটের আওতায় ব্যয় পরিকল্পনা করে থাকে। যা বর্তমান বছরের বাজেটেও রয়েছে। এর মধ্যে রাজস্ব ব্যয় ১১.০৫%, উন্নয়ন ব্যয় ৪.৯৮% এবং অন্যান্য ব্যয় ১.৫৯%। অনুন্নয়ন খাতে সরকারী পরিচালনায় বেতন-ভাতাদি, ক্রয়, অফিস পরিচালনা ইত্যাদিতে ব্যয় সিংহভাগ ব্যয়িত হয়। এ ব্যাপারে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে ব্যয় দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। ৫. বাজেটে ভারসাম্য ও অর্থায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাজেটের আয়-ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান দেখা দিলে ঘাটতি দাঁড়ায়। ফলে সরকারকে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা কাম্য নয়। বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতির ধারাবাহিকতা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কোন বিশেষ কারণ ব্যতীত বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫% কিংবা এর কাছাকাছি অবস্থান করে থাকে। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ কাস্টম বিভাগ নৈতিকতার ভিত্তিতে রাজস্ব আহরণে যদি এগিয়ে আসে তবে এ রাজস্ব ঘাটতির অপবাদ থেকে সরকার মুক্ত হবে। এখানে উল্লেখ্য, সরকারী ব্যয় বরাদ্দ সাধারণত তিনটি মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। যেমন, আঞ্চলিক সমতা, উন্নয়ন অবকাঠামো ও মানসম্মত ব্যয়। সবশেষে ২০২১ সালে বাংলাদেশের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে পৌঁছানো। এজন্য অপরিহার্য শর্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ থেকে ৮ শতাংশ নিশ্চিত করা। বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই কেবল এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। রাজস্ব আয় বাড়ানো এর শর্ত। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দরকার করবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। সেখানে রাজস্ব প্রদানে সেবা নিশ্চিত, অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইনকানুন সময়োপযোগী করা গুরুত্ব পাবে। পরিকল্পনাজনিত সমস্যা তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক নানা জটিলতা। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
×