ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এলিজা খাতুন

ছোট কাগজ ॥ ভাবনার চালচিত্রে ‘অপরাজিত’

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২০ নভেম্বর ২০২০

ছোট কাগজ ॥ ভাবনার চালচিত্রে ‘অপরাজিত’

সাহিত্যচর্চার যথাযথ মাধ্যম হিসেবে ছোট কাগজের বিকল্প চোখে পড়েনি। লিটল ম্যাগাজিনকে সাহিত্যের বহমান স্রোত বলব। পৃষ্ঠা হিসেবে বা আকৃতিতে যেমনই হোক, এর ব্যপ্তি অপরিমাপযোগ্য। ভিন্ন ভিন্ন গঠনমূলক চিন্তা বা মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের সমাবেশ ঘটানো, তা একের কাছে অন্যেরটা পৌঁছানো, প্রচার, প্রসার, নতুন চিন্তা ও মননের সংযুক্তি বিযুক্তি, যে কোন আঙ্গিকেই লিটল ম্যাগাজিন অদ্বিতীয়। সেটা কয়েকটি পাতায় হতে পারে কিংবা কয়েক শ’ পাতাতে। সাহিত্যের ছোট কাগজ দেখিয়ে দেয় গভীর পরিমণ্ডলে বিষয়ভিত্তিক চর্চা কত উজ্জ্বলভাবে সম্ভব। নিরীক্ষাধর্মী রচনা প্রকাশে ছোট কাগজের ভূমিকা গুরুত্ববহ এবং যাবতীয় ভঙ্গুরতায় দাঁড়িয়ে নতুন স্তম্ভ নির্মাণ তার বিশেষ লক্ষ্য হতে হয়। সাহিত্য ভাবনার ছোটকাগজ ‘অপরাজিত’ এই সকল অনুষঙ্গ ধারণ করছে অনায়াসে বলা যাবে। অপরাজিত সম্পাদক নাহিদ হাসান রবিন তাঁর নিপুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন অনবদ্য এই সংখ্যাতে। প্রারম্ভে সূচীপত্রেই অবলোকন হয় অপরাজিত’র সমৃদ্ধ আয়োজন। গদ্য, কবিতা, গল্প, এ তিন বৈচিত্র্যে সাজানো হয়েছে এবারের সংখ্যা। কবিতার খোঁজে অগ্রজ কবি শিবলী মোকতাদির পাঠককেও সঙ্গে করে নিয়ে চলেছেন, কোথায় নয়! জড়-অজড়ের সীমা অতিক্রম করে, শ্যাওলা পড়া পাঁচিল টপকে, যুদ্ধ-যন্ত্রণায়, মানে-অভিমানে, স্নায়ুযুদ্ধে-মিথস্ক্রিয়ায়, খাল বিল নদী, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হাঁসের পালকের নিচে, তীর্থের ব্যঞ্জনা নিয়ে বিচিত্র বুনটের ফাঁদে ভাসিয়ে বন থেকে বনান্তরে, নতুন আগ্নেয়গীরির পথে হাঁটিয়ে পাঠককে কবিতা সন্ধানী পথিক-এ পরিণত করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এমনকি তিনি অপ্রত্যাশিত মৃত্যুরোধেও কবিতার জয়গান গেয়েছেন। এবং উপলব্ধি করিয়েছেন কবিতার ভাঁজে ভাঁজে শাশ্বত সর্বজনীন অনুভূতির বসবাস। বিস্ময় জাগায় কবিতা প্রসঙ্গে লেখা গদ্য পড়তে পড়তে মনে হয় সম্পূর্ণ গদ্যটিই একটা কবিতা। আর তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এটাই বলব- ‘কবি যেন সমুদ্রে ভেসে থাকা বিরাট আর নির্জন এক মাস্তুল’। এমনই বিস্ময়কর বার্তা পাঠকের দ্বারে কাঁধে করে পৌঁছে দেয়ার জন্য অভিবাদন অপরাজিতকে। সাহিত্য আলোচনায় যে বিষয়সমূহ বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক মনে করি তার ভেতরে সাহিত্যের উদ্দেশ্য, আদর্শগতদিক, বিষয়-বক্তব্য, সৃজনশীলতা, শব্দবোধ, পরিপ্রেক্ষিত চিন্তা, নান্দনিকতা, দর্শনের আঙ্গিক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি লেখা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বিশ্লেষণ করার অবকাশ যদিও মেলেনি, প্রথম পাঠের অনুভূতি ব্যক্ত করতেই পারি। অপরাজিত’র এ সংখ্যা দশজন কবির কাব্যবৈচিত্র্যে অলঙ্কৃত হয়েছে। অগ্রজ কবি গোলাম কিবরিয়া পিনুর তিনটি কবিতাই অপূর্ব সৃষ্টি। শিল্পমণ্ডিত শব্দ ও ভাবের প্রয়োগ দেখতে পাই। কাব্য বিকাশের অভিনবত্বে পৃথক পৃথকভাবে স্বাদ গ্রহণ করায় ; যা আত্মোপলব্ধিমূলক। অগ্রজ কবি মাহমুদ কামাল এর লেখা ‘গোরাচাঁদ ভবন’, ‘উপুড় হওয়া নদী’, ‘রূপকথা’ তিনটি কবিতাই মনন ও মানসিকতাকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা নিয়ে চমৎকার কাব্যময়তায় সৃষ্টি হয়েছে; যা সমসাময়িক প্রেক্ষিত এবং কাক্সিক্ষত সময়ের স্বর ধারণ করেছে। কবি মিলু শামসের দুটি কবিতা ‘প্রতীক্ষা’, ‘আগত’ স্বল্প পরিসরে প্রস্ফুটিত সুঘ্রাণযুক্ত ফুল যেন! দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে তার রেশ। কবি মামুন রশীদ এর ‘বৃষ্টি’, ‘প্রশ্ন’, ‘অভিশাপ’ তিনটি কবিতা পাঠে ভিন্নধর্মী প্রকাশভঙ্গির সন্ধান পাই, তাতে মৌলিকত্ব আছে। এবং সুক্ষ্ম প্রহসনের মিশেল কবিতার শৈল্পিকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে বলে অনুভব হয়। এখানে প্রকাশ পেয়েছে আমারও তিনটি কবিতা। যার সমলোচনা করবেন পাঠক। এরপর মাহবুবা ফারুক ও শারমিন সাথী লিখেছেন দুটি করে কবিতা। এবং মনিরা ইয়াসমিন, শিল্পী মাহমুদা, সেলিম রেজা কাজল আছেন একক কবিতায়। তাদের প্রত্যেকটি কবিতাই ভাব ভাষা গাঁথুনিতে চমৎকার বুনন-রূপ দেখলাম। গল্পকার সমীর অহমেদ এর ‘নেতা’ গল্পটি প্রকাশের ভাষা সহজ, তবে সুদৃঢ়। ঐতিহাশিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনতার মঞ্চ একেবারে জীবন্ত হয়ে ওঠে পাঠকের পাঠকালীন মুহূর্তে। লেখক নির্মোহ ভাষাবন্ধনে জাতীয়তা বোধের উন্মেষ ঘটাতে দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। কাবেদুলের উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা পাঠক মনের চিরন্তন প্রত্যাশা; যা গল্পটিকে সফলতার পথে হাঁটিয়ে নেয়। ‘ময়না বউ এর গর্ভযন্ত্রণা’ গল্পের প্রারম্ভেই গল্পকার শেলী সেনগুপ্তা গ্রামীণ বসতির চিরন্তন দৃশ্যপট এঁকে দিলেন পাঠকের চিন্তার ক্যানভাসে। ‘গল্পটা আগেই লেখা হয়েছে’ এ উপলব্ধি যথার্থরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় গল্পের অন্তিমে। চমৎকার গল্পটি প্রথম থেকে পাঠ-ধৈর্যের ফলাফল পাঠককে গল্পের শেষে সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেয় যেন। অন্যধারার বা অন্যমাত্রার আমেজ আবির্ভূত হয় পাঠানুভবে সাহিত্যবোদ্ধাদের চালচিত্রের সামান্য দশা অসামান্য ব্যাঙ্গাত্মকরূপে তুলে ধরেছেন গল্পকার অলাত এহসান। গল্পকার লতিফ আদনান এর ‘মা ভবানি পরিবহন’ গল্পটি সুখপাঠ্য। সমাজের বৈরি হাওয়ায় চিরকালীন চিত্র ধারণ করেছে মজবুত বাক্য বিন্যাসে এক কথায় বলা যাবে গল্পটি পাঠক হৃদয়ে আদৃত। ‘বিজয়’ কত বিচিত্র! কত বিস্ময়ের! কতটা আত্মিক তা উপলব্ধি করা যায় লেখক নাহিদ হাসান রবিন এর ‘এ অশ্রু বিজয়ের’ গল্পপাঠে। গল্পটি আধুনিকতার দাবি রাখে। লেখক গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সহজ ভঙ্গিমায় গেয়েছেন মানবতার গান। বুনেছেন সুন্দর সমাজের স্বপ্নজাল। লেখাটিতে তিনি সময়ের কাক্সিক্ষত কণ্ঠস্বর ধারণ করেছেন। গল্পকার সেলিনা জামান এর ‘স্বজন স্বদেশ’ এক অসাধারণ গল্প। শুরুটা বেশ আকর্ষণীয়। স্বল্পদৈর্ঘ্যে স্বদেশের চিত্র তুলে ধরার চমৎকার নৈপুণ্যতা দেখি। পাঠক বিমুগ্ধ পদক্ষেপে বিরতিহীন হেঁটে যাবেন জননী জন্মভূমির আল ধরে। আবু সাঈদ ফকিরের ঘুণ লেখাটি সমাজের প্রতিষ্ঠিত অজ্ঞতা ও অসচেতনতামূলক ঘটনার চিরন্তন বর্ণনা। কিছুটা পড়বার পরেই আদ্যোপান্ত ঘটনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। গল্পের গল্পটা যেন পাঠক চিনে ফেলে অগ্রিম। গল্প বলে যাবার ধারাবাহিকতা বেশ সুশৃঙ্খল। ঘুণ নামটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গল্পকার হোসনে আরা মনি’র ‘খেলাঘর’ গল্পটি ভিন্নমাত্রার মর্মস্পর্শী। শব্দসম্ভার বাক্যবিন্যাস গাঁথুনিতে অনন্য গল্প খেলাঘর। সমস্ত লেখা পাঠে বলতে পারি অপরাজিত’তে সংযোজিত গদ্য কবিতা গল্পসমূহের মধ্যে দুঃখ-ব্যথা, ভালবাসা মানবতাবোধ ন্যায্যতা, সাম্যতা, সমাজের অসঙ্গতি, সমসাময়িক চালচিত্র’র বহির্প্রকাশ ঘটেছে। বহুমাত্রিক বোধ-বিশ্বাসের চিত্র বিভিন্ন লেখায় পঙ্ক্তিতে উঠে এসেছে। এবং সে সকল সুচারুরূপে পাঠকের সম্মুখে তুলে দেয়া কার্যে সম্পাদকের আন্তরিকতা ও নিরলস প্রচেষ্টা প্রশংসাযোগ্য। এবং তাঁর সহজ-সাদামাটা প্রচ্ছদভাবনা আড়ম্বরহীন সৌন্দর্যে শিল্পময়। এটা বেশ ভাললাগার। অপরাজিত মানে-গুণে অক্ষুণ্ন থেকে নিজস্ব স্বকীয়তায় আরও প্রসারিত হয়ে স্থান-কাল-পাত্রের উর্ধে দাঁড়িয়ে মানুষ ও মানবতার পক্ষে কাজ করে চলুক এ কামনা নিরন্তর।
×