ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রণি

এনহেদুয়ান্না ॥ প্রথম কবি

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২০ নভেম্বর ২০২০

এনহেদুয়ান্না ॥ প্রথম কবি

কয়েক হাজার বছর আগেও যে নারীরা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন কবি এনহেদুয়ান্না। এই মহীয়সী নারীকে মনে করা হয় পৃথিবীর প্রথম কবি। যদিও পৃথিবীর প্রথম কবিকে নিয়ে অনেকের মুখে অনেক রকমের বক্তব্য শোনা যায় কিন্তু এনহেদুয়ান্নার আগে আর কোন কবি পৃথিবীতে এসেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে পায়নি গবেষকরা। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও ২২৫৮ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার ২৭৭ বছর আগে তাঁর বিচরণ ছিলো পৃথিবীতে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২২৮৫ অব্দে তাঁর জন্ম হয়। সে সময় নারীসমাজ ততটা অগ্রসর হয়ে ওঠেনি। শিক্ষাদিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা ছিলেন পুরুষদের তুলনায় অনেকখানি পিছিয়ে। কিন্তু এনহেদুয়ান্না তাঁর প্রজ্ঞা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে নিজেকে অন্যদের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সমগ্র নারীজাতির গৌরবের প্রতীকে পরিণত হন। অবশ্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদেও নারীর উপস্থিতি টের পাই আমরা। চর্যাপদে একজন মাত্র নারী কবির হদিস পাওয়া যায়, তাঁর নাম কুক্কুরিপা। কিন্তু একজন হলেও সেটা ছোট করে দেখবার অবকাশ নেই। কেননা, একেবারেই শূন্যতা বিরাজ করার চেয়ে একজনের উপস্থিতি কখনও কখনও হয়ে ওঠে হাজার মানুষের কণ্ঠস্বর। তাই কুক্কুরিপাকে আমরা মনে করতে পারি আমাদের বাংলা সাহিত্যের সমগ্র নারী জাতির কণ্ঠস্বর। চর্যাপদের ভাষা হয়তোবা শতভাগ বাংলা ছিল না, তারপরও বলা যায় কুক্কুরিপার মতো কবির জন্ম না হলে বাংলাভাষার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর মতো একজন সাহসী লেখককে আমরা পেতাম না। একজনের হাত ধরে এগোতে এগোতে বর্তমানে অজস্র নারী আমাদের সাহিত্যকে ঋদ্ধ করে চলেছেন। তাঁদের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক শিল্পোত্তীর্ণ সৃষ্টিকর্ম। সুতরাং সবকিছু সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সুমেরীয় কবি এনহেদুয়ান্না মাত্র ২৭ বছর বয়সে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একটি দেবালয়ের। আক্কাদের অধিপতি সারগন ও তাঁর স্ত্রী তাশলুলতুমের মেয়ে ছিলেন তিনি। অবশ্য তাঁর পিতৃপরিচয় নিয়ে ভিন্নমতও শোনা যায়। কবি এনহেদুয়ান্না বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৫ বছর। অসামান্য মেধা, সততা ও কর্মনিষ্ঠার গুণে, সর্বোপরি দেবালয় নেতৃত্ব দেয়ার বদৌলতে তৎকালীন আক্কাদিয়ানরা তাঁকে দেবীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এমনকি একসময় তাঁকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হিসেবেও গণ্য করা হতো- পুরুষশাসিত বিশ্বে একজন নারী হিসেবে এটা ছিল তাঁর ঐতিহাসিক বিজয়। এনহেদুয়ান্না জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপন মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। প্রার্থনাসঙ্গীত এবং কবিতা লিখতেন তিনি। তাঁর আগে পৃথিবীতে আর কোন লেখকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও রামায়ণের লেখক, আদিকবি বাল্মিকীকেই কেউ কেউ পৃথিবীর প্রথম কবি হিসেবে দাবি করেন কিন্তু এযাবৎকালে আবিষ্কৃত পৃথিবীর প্রথম লেখক হিসেবে কবি এনহেদুয়ান্নার নামটাই বার বার উঠে আসে। ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে এনহেদুয়ান্নার প্রায় ৪০টিরও অধিক ভক্তিসঙ্গীত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে দেবী ইনানাকে নিয়ে লেখা তাঁর আরও কিছু স্তূতিগানের হদিস পেয়েছেন বলে গবেষকরা দাবি করেন। কিউনিফর্মে সাহিত্যের মাঠ সোনার ফসলে পরিপূর্ণ করে তোলা পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না চিরকুমারী জীবনযাপন করে খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ অব্দে পৃথিবীর মায়াত্যাগ করে চলে পরভুবনে। পৃথিবীর কোন পুরুষের সঙ্গে তিনি সংসার পাতেননি। কিন্তু কবিতার সঙ্গে যে সংসার পেতেছিলেন, বংশ-পরম্পরায় তা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে পৃথিবীতে, হয়তো লক্ষ কোটি বছর ধরেই টিকে থাকবে তাঁর কর্ষিত জমিনের উৎপাদিত ফসলের প্রথম বীজ-কবিতা!
×