ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাদা নোমান

অভিমত ॥ ৬২ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২০ নভেম্বর ২০২০

অভিমত ॥ ৬২ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি ও বাস্তবতা

বিভিন্ন পত্রিকায় সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি দেখলাম, যেখানে দেশের ৬২ জন বিশিষ্ট নাগরিক তথা বুদ্ধিজীবী পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার চিম্বুক-থানচি সড়কে ম্রো জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় বিনোদন পার্ক স্থাপন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিবন্ধটি পড়ার পর মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে আর তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। এই বিবৃতিতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু তা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি অবশ্য তাদের মতো এত উচ্চশিক্ষিত নই বা জ্ঞান-বুদ্ধিতে তাদের ধারেকাছেও নেই। তবে তাদের এই বিবৃতি পড়ে মনে হচ্ছে যে, তাদের হয়তো অন্য বিষয়ে অগাধ জ্ঞান থাকতে পারে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে এবং এখানকার বাস্তবতা সম্বন্ধে তাদের ধারণা তুলনামূলক কম। এখানে তাদের কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমত, যে এলাকায় এই পাঁচ তারকা হোটেলটি নির্মাণ নিয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে, সে এলাকাটি সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা আছে কিনা? তারা কি কখনও সরেজমিনে গিয়ে জায়গাটি দেখেছেন? আদৌ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাদের বসতভিটা হতে উচ্ছেদ করা হয়েছে কিনা এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কি পরিমাণ চাষাবাদের জমি ধ্বংস হয়েছে, সে বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করে দেখেছেন কিনা? আমি জানি, এর উত্তর হবে না। তাদের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য জানাতে চাই। যে এলাকাটি নিয়ে এই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত ১৫টি পর্বতমালা বা জধহমব এর অন্যতম চিম্বুক পাহাড়ের চন্দ্রপাহাড় নামক স্থানে অবস্থিত তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত জঙ্গলাকীর্ণ একটি এলাকা, যা সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি নয়। চিম্বুক পাহাড় আনুমানিক ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা বান্দরবান সদরের তেঁতুলপাড়া নামক স্থান থেকে শুরু হয়ে সীমান্ত পিলার ৬৪ অতিক্রম করে মিয়ানমারে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে মাত্র ২০ একর জমি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত প্রথা ও রীতি মেনে সেখানকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি অর্থাৎ, হেডম্যানের অনুমতি সাপেক্ষে বান্দরবান জেলা পরিষদের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে ৩৫ বছরের জন্য লিজ নেয়া হয়েছে। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, বিবৃতিতে উল্লিখিত ম্রো উপজাতির শ্মশান, পবিত্র পাথর, পবিত্র পর্বত ইত্যাদি নষ্ট করে হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বস্তুত সেখানে কোন জনবসতিই নেই। কাজেই সেখান থেকে ম্রো সম্প্রদায়ের ১০,০০০ মানুষকে তাদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করার যে গল্প তৈরি করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আর এরূপ একটি কল্পকাহিনীকে কোন প্রকার যাচাই-বাছাই না করে শুধু অন্যের কথা আমলে নিয়ে কিভাবে তারা এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেন, তা ভেবে পাচ্ছি না। এখানে তাদেরকে আরও একটি প্রশ্ন করতে চাই, বলুন তো পৃথিবীর সর্বোচ্চ ও দীর্ঘ পর্বতমালা হিমালয়ের মালিক কে? সেখানে বসবাসকারী তামাং, লিম্বু, গোলা বা সেরপা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, না নেপাল ও ভারত সরকার? নিশ্চয়ই বলবেন সরকার। তাহলে কিভাবে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই চিম্বুক পাহাড়ের মালিকানা সেখানে বসবাসরত একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর হতে পারে? প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক শুধু হিমালয় পর্বত দেখতে ভারত ও নেপালে গমন করে। আর এই পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে সেখানে গড়ে উঠেছে শত শত হোটেল ও রিসোর্ট, যা কিনা উভয় দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। এখন যদি সেখানকার জনগণ এই হিমালয়ে হোটেল বা রিসোর্ট তৈরিতে বাধা দিত, তাহলে তাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কি হতো, তা ভেবে দেখেছেন কি? তাই হিমালয় যদি কারও ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি না হয়ে থাকে, তাহলে চিম্বুক পাহাড়ের মতো বিশাল একটি পর্বতমালা কিভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক মানুষের সম্পত্তি হয়, তা ক্ষুদ্র জ্ঞানে বোধগম্য নয়। অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, এই চিম্বুক পাহাড়েই কিন্তু ইতোমধ্যে সাইরু নামে পাঁচ তারকাবিশিষ্ট ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি রিসোর্ট তৈরি হয়েছে, যা এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। কই, সেটা নিয়ে তো কোন কথা বলছেন না কেউ। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চন্দ্রপাহাড়ে হোটেল নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। তখন কিন্তু কেউ এর বিরোধিতা করেনি। তাহলে এখন কোন উদ্দেশ্যে এ সকল আন্দোলন, মিটিং-মিছিল বা বিবৃতি প্রদান করা হচ্ছে, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে সরকার যখন পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, ঠিক তখনই পর্যটনবান্ধব একটি প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করতে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। একটি বিশেষ মহল চায় না যে, এ অঞ্চলের মানুষ পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করুক। দারিদ্র্যতার কষাঘাত থেকে বেরিয়ে আসুক। কেননা, তারা জানে যে, অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করলে এ সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণকে আর দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা যাবে না। পাওয়া যাবে না তাদেরকে পুঁজি করে বিদেশী দাতা সংস্থার কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি ডলার-পাউন্ড। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী দরিদ্র ও নিপীড়িত বাঙালী জনগোষ্ঠী, যারা কিনা সেখানে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, তাদের না আছে ভূমির ওপর কোন অধিকার, না ভোটাধিকার, না শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কোন কোটা। এখানে বসবাসকারী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে কোন প্রকার আয়কর প্রদান করতে হয় না এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে থেকে সরকার রাজস্ব পর্যন্ত পায় না। অথচ প্রতিবছর পাহাড়ের সার্বিক উন্নয়নে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। শান্তি চুক্তির এত বছর পরও পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে প্রতিনিয়ত এখানকার সাধারণ মানুষের শাস্তিসহ মৌলিক অধিকার হরণ করছে, চাঁদাবাজিতে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে জুম্মল্যান্ড তৈরির স্বপ্ন দেখছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে কাউকে তেমন কথা বলতে দেখা যায় না। আপনারা দেশের সুশীল সমাজ, জাতির বিবেক। দেশে আপনাদের অনেক সম্মান, অনেক নামডাক। আপনাদের কাছে আমরা সব সময় পক্ষপাতবিহীন বক্তব্য ও ন্যায় বিচারের আশা করি। কারও ষড়যন্ত্র বা প্রতারণার ফাঁদে পা না দিয়ে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে বিষয়গুলো গভীরভাবে বিবেচনা করুন। তাহলেই আপনার-আমার সর্বোপরি আমাদের দেশ ও জাতির মঙ্গল। লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক [email protected]
×